মিয়ানমার কি কয়েক টুকরা হয়ে যেতে পারে?

fec-image

শান স্টেটে ব্রাদারহুডকে অভিযান চালাতে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের ওপর চীন ব্যাপকভাবে হতাশ। শান স্টেটের অনলাইন প্রতারণা কেন্দ্রগুলোয় কয়েক হাজার চীনা নাগরিক রয়েছেন। তারা পাচারের শিকার হয়েছেন। তাদের দাসদের মতো কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এ কেন্দ্রগুলো বন্ধে জান্তা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা চীন সরকারকে হতাশ করেছে।

চীনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে সহিংসতা দমনে অকার্যকর ব্যবস্থাপনার কারণে মিয়ানমার রাষ্ট্র হিসেবে ভেঙে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিশাল আকারের ভূখণ্ড হারানোর পর তাঁর দিক থেকে এ সতর্কবার্তা আসে। মিয়ানমারের জনগণকে সামরিক বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান মিন্ট সোয়ে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, তাঁর এই আহ্বান মানুষ কানে তুলবে না।

সামরিক সরকার দেশের অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ হারালে ভীত হওয়া তো দূরে থাক মিয়ানমারের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের বেশির ভাগই সেনাবাহিনীর পরাজয় উদ্‌যাপন করছে। সামরিক জান্তা সরকার জনগণের মনোভাব পড়তে ভুল করেছে। অবশ্য এই ভুল তারা এবারই প্রথম করেনি। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ এবং লাগাতার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দেখে সেনা অভ্যুত্থানের নেতারা বিস্মিত হয়েছিলেন।

বিরোধিতা দমনের জন্য সামরিক নেতারা নির্বিচার গ্রেপ্তার ও চূড়ান্ত মাত্রার সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছেন। রাজনৈতিক বন্দীদের সহায়তা দেয় এ রকম সংস্থার মতে, বর্তমানে ১৯ হাজার ৬৭৫ জন রাজনৈতিক বন্দী এখন কারাগারে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবাদকারী ব্যক্তিদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সেনারা স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম দমাতে গিয়ে নিয়মিতভাবেই জনসাধারণের ওপর শাস্তির খড়্গ চাপিয়ে দিয়ে আসছে। মানুষের বসতি ও স্থাপনায় তারা ভয়াবহ বিমান হামলা করছে। এই শুদ্ধি অভিযানে হাজারো মানুষ নিহত হয়েছে। সাত লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

২০২১ সালে জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠিত হয়। নির্বাসিত নেতাদের এই ছায়া সরকার রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ শুরু করে। তারা সামরিক জান্তা সরকার ও তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য সশস্ত্র যোদ্ধা গড়ে তোলে। এনইউজির সশস্ত্র যোদ্ধারা মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কয়েক ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে চলেছেন। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী কয়েক দশক ধরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে।

এখন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শক্তিশালী হামলার মুখে সরকারি সেনারা প্রতিনিয়ত তাঁদের ব্যারাকগুলো থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তাঁরা বিমানশক্তির ওপর ঝুঁকে পড়ছেন। কিন্তু স্থলে তাঁদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ছে। ধারাবাহিকভাবে সামরিক জান্তা সরকার অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে এবং ভূখণ্ড হারাচ্ছে।

এ বিষয় মিয়ানমারের জান্তা সরকারের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জান্তা সরকারের বৈধতা নির্ভর করে পুরো দেশের ওপর তারা কতটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে, তার ওপর। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর খসড়া করা সংবিধানে কয়েক ডজনবার মিয়ানমারের ‘অখণ্ডতা’ শব্দটি এসেছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব হিসেবেই সংবিধানে ‘অখণ্ডতা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানকে বৈধতা দেওয়ার মূল চাবিকাঠি এটি। কেননা, পরবর্তী পাঁচ দশকের সামরিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে ওই অভ্যুত্থান।

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যে (১৯৪৮-৬২) মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারকে দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সে সময় প্রধান প্রধান কয়েকটি শহর বাদে বাদবাকি এলাকার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুব বেশি ছিল না। এখন পরিস্থিতি আবার সে রকম। শহর ও সেনা ব্যারাকের বাইরে জান্তা সরকার আর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না। এটি খুব খারাপভাবে জান্তার নৈতিক বল ভেঙে দিচ্ছে। জনগণের মাঝে প্রতিরোধের প্রেরণা তৈরি করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে জান্তা সরকার সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে শান স্টেটে। জাতিভিত্তিক তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্মিলিত আক্রমণে বিশাল একটা এলাকার নিয়ন্ত্রণ তারা হারিয়েছে। এই তিন গোষ্ঠী হলো, আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি ও টাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। এই তিন সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স (ভ্রাতৃত্ব জোট) গড়ে তুলেছে।

নভেম্বরে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের কাছে সামরিক বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। বেশ কয়েকটি সেনা ব্যারাকের নিয়ন্ত্রণ তারা হারিয়েছে। ৯৯তম পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এই ডিভিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছিল।

ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স মান্দালয় থেকে চীন পর্যন্ত প্রধান সড়কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই সড়ক মিয়ানমারের প্রধান অর্থনৈতিক করিডর।

ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্যরা নিজেদের ভূখণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও তাঁরা নির্ভরশীল চীনের অস্ত্রের ওপর। সে কারণে চীনের হিন্টারল্যান্ড (পশ্চাৎভূমি) হিসেবে পরিচিত একটি অঞ্চলে হামলা করা বেইজিংয়ের সম্মতি ছাড়া সম্ভব হতে পারে না।

শান স্টেটে ব্রাদারহুডকে অভিযান চালাতে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের ওপর চীন ব্যাপকভাবে হতাশ। শান স্টেটের অনলাইন প্রতারণা কেন্দ্রগুলোয় কয়েক হাজার চীনা নাগরিক রয়েছেন। তারা পাচারের শিকার হয়েছেন। তাদের দাসদের মতো কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এ কেন্দ্রগুলো বন্ধে জান্তা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা চীন সরকারকে হতাশ করেছে।

চীনের কৌশলগত অবস্থানে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান নিয়ে চীনকে ততটা উৎসাহিত হতে দেখা যায়নি। মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ছেন হাই সাংবাদিকদের বলছিলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা সত্যিকার অর্থে চীন দেখতে চায়নি।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের নেতারা ঐতিহ্যগতভাবেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধান মিত্র। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া অং সান সুচির সঙ্গেও তাঁরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অনেক সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গেও তাঁরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখে চলেন।

এখন মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর থেকে জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি—এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন সরকারের কৌশলগত অবস্থান বিপরীত দিকে ঘুরে যাচ্ছে। চীনের নেতারা মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্ভবত ভালো করেই বুঝতে পারছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন, জান্তা সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া তাঁদের জন্য মরণফাঁদ হতে পারে।

অন্য মিত্ররা চীনের নেতাদের মতো এতটা চতুর নন। চীনকে হটিয়ে রাশিয়া এখন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে মিয়ানমার ৪০৬ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। রাশিয়ার কাছ থেকে বিমানের জ্বালানি নেওয়ার বিনিময়ে মিয়ানমার রাশিয়াকে অর্থ এবং বঙ্গোপসাগরের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। রাশিয়াকে এ অঞ্চলে তারা প্রাসঙ্গিক হওয়ার সুযোগও করে দিয়েছে।

জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইং সম্প্রতি রাশিয়ার নৌবাহিনীকে মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ মহড়ায় স্বাগত জানান। ভ্লাদিমির পুতিনকে তিনি ‘বিশ্বনেতা’ আখ্যা দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছেন পুতিন।

এরপর কী?
সামরিক জান্তা-পরবর্তী মিয়ানমার কেমন হবে, তার একটি পরিকল্পনা করছে এনইউজি। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সু চির নেতৃত্বে একটি ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমার প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে এটা পছন্দনীয় সমাধান নয়।

তারা ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা চায়। তারা চায় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা হোক। সু চি যখন সবশেষ ক্ষমতায় ছিলেন সে সময় এ দুটি ইস্যুতে তাঁর বক্তব্যে তারা সন্তুষ্ট নয়।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার যে পতন হতে চলেছে, সেটা একেবারে স্পষ্ট। কিন্তু সেটা খুব তাড়াতাড়ি হবে, তা নয়। পরাজয় বুঝতে পেরে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এখন ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে পারে। সে কারণেই জান্তা সরকারের পতন যত শিগগিরই হয়, ততই মঙ্গল।

মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো, আসিয়ান ও পশ্চিমা শক্তিগুলো মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কঠোর ভাষায় কথা বলে। তাদেরকে অবশ্যই লড়াইরত সব গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে জান্তা-পরবর্তী মিয়ানমারের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

* রোনান লি যুক্তরাজ্যের লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর মিডিয়া অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিসের ভাইস চ্যান্সেলর ইন্ডিপেনডেন্ট রিসার্চ ফেলো। সূত্র: প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন