রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
কফি আনান কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিত্ব দিয়ে প্রত্যাবাসন নয়, বাঙালি অভিবাসী হিসেবে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। আন্তর্জাতিক চাপে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে ‘বাঙালি অভিবাসী’ হিসেবে নিজ বসতাড়িতে পুনর্বাসনের পরিবর্তে শরণার্থী ক্যাম্পে বন্দী করার কাজ শুরু করেছে। এক সপ্তাহ আগে থেকে আরাকানের মংডুর বলিবাজার-শাববাজারের ছয় কিলোমিটার এলাকায় ক্যাম্প নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রাণ বাঁচাতে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমার বাহিনী। আন্তর্জাতিক চাপে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে মিয়ানমার সরকার এখন তাদের ঘরবাড়ি না থাকার অজুহাতে শরণার্থী হিসেবে ক্যাম্প বন্দী করতে চাইছে।
 
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সরকার ২০১২ সাল থেকে এক লাখ ৪০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক আকিয়াবে বাংলাদেশী অভিবাসী শরণার্থী হিসেবে ক্যাম্পে বন্দী করে রেখেছে।
 
গত ২ নভেম্বর আকস্মিকভাবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি মংডুর দক্ষিণের নলবনিয়া পরিদর্শন করেন। আকিয়াব (সিটওয়ে) বিমানবন্দরে অবতরণ করে হ্যালিকপ্টারে মংডুর দক্ষিণের নলবনিয়ায় আসেন। এ এলাকায় টাঙানো প্যান্ডেলে আগে বাছাইকৃত প্রায় ৫০ জন রোহিঙ্গার সাথে মিটিং করেন অং সান সু চি। এ সময় তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী ক্যাম্প (আশ্রয় কেন্দ্র) নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের দোভাষীর মাধ্যমে আরো বলেন, তোমাদের কী সমস্যা? তোমাদের কী প্রয়োজন আমাকে বলো। তোমাদের সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা হবে, তোমরা ভালোভাবে থাকতে পারবে, এখন তোমাদের কিছু বলার থাকলে বলো। উত্তরে ওই বাছাইকৃত রোহিঙ্গারা বলেছেন ‘আপনাকে আমাদের কিছু বলার নাই।’
 
রোহিঙ্গাদের সাথে মতবিনিময়কালে সু চি বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য শরণার্থী ক্যাম্প (আশ্রয় কেন্দ্র) নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি।’ তিনি শরণার্থী ক্যাম্প নির্মাণের নকশা প্রণয়নকারী এক নারীকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কিভাবে শরণার্থী ক্যাম্প নির্মাণ করা হবে, তার নকশা এর কাছে রয়েছে। তোমরা চাইলে তার সাথে বসে নকশায় পরিবর্তন আনতে পার।’ সু চি বলেন, ‘শরণার্থী ক্যাম্প নির্মাণে গ্রামবাসীরা মিলে সহযোগিতা করলে সাফল্য অর্জিত হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে তার সরকার। তাই সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
 
এ সময় অং সান সু চি উপস্থিত রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে হেসে হেসে বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে হবে। শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া শিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাও থাকবে।’ ১৫ মিনিটের এ বৈঠকে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কিছুই শুনতে চাননি তিনি। এরপর নলবনিয়া গ্রামের আশপাশে সেনাদের দেয়া আগুনে ভস্মীভূত কিছু গ্রাম পরিদর্শন করে আকিয়াবের উদ্দেশে মংডু ছেড়ে যান।
 
উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী সু চিকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতায় আরোহণ করে জান্তা সরকার। সে থেকে বিগত ২৭ বছর পর আরাকানে পা রাখেন সাবেক জেনারেল অং সান কন্যা। অবশ্য এর আগে ২০১০ সালে বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হন তিনি। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতা ফিরে পান। গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে আরকার রাজ্যে উগ্রপন্থী ধরার নামে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী লোমহর্ষক নির্যাতন চালালেও নীরব থাকেন সু চি। এ নিয়ে সারা বিশ্বে নায়িকা থেকে খলনায়িকায় পরিণত হন অং সান সু চি।
সূত্র জানায়, আরকান রাজ্যের মংডুর ৩০ কিলোমিটার দূরে বলিবাজার থেকে শাববাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই শরণার্থী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা মুসলমান ও হিন্দুদের শরণার্থী ক্যাম্পে বন্দী করে রাখার জোর প্রস্তুতি শুরু করেছে মিয়ানমার।
 
মিয়ানমার সরকার বলিবাজার থেকে শাববাজার পর্যন্ত শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি করছে। ‘শাববাজার থেকে বলিবাজারের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। এই পুরো জায়গায় ক্যাম্প তৈরি করছে মিয়ানমার সরকার। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, এই দু’টি স্থানে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগরা দখল করেছে। বলিবাজার-শাববাজার বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তের কাছেই অবস্থিত।’ প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে বলিবাজার-শাববাজার এলাকায় ক্যাম্প স্থাপনের কাজ শুরু হয়।
 
স্থানীয় রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে থাকতে দেয়া হবে না, এ কারণে ক্যাম্প করছে সরকার। মিয়ানমার সরকার ইতোমধ্যেই দাবি করেছে, তারা রোহিঙ্গাদের নিতে চাইলেও ঢাকা অনুমতি দিচ্ছে না।
পূর্বঘোষণা ছাড়া সু চির এ সফর নিয়ে রোহিঙ্গারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া ছাড়া উপায় দেখছে না মিয়ানমার সরকার। তাই এ চাপকে নমনীয় করতে আরাকান পরিদর্শন করেছেন সু চি। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে বন্দী করে রাখতে দ্রুতগতিতে ক্যাম্প নির্মাণের কাজ শুরু করতে চাইছে মিয়ানমার। এই দিকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশের সাথে একমত হতে পারছে না মিয়ানমার। বাংলাদেশ চাইছে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে করা দুই দেশের প্রত্যাবাসন নীতিতে পরিবর্তন এনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে আরাকানে ফেরত পাঠাতে।
 
কিন্তু মিয়ানমার প্রত্যাবাসন নীতি পরিবর্তনীয় রেখে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছে। বিশেষ করে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার এবং রোহিঙ্গাদের নিজ বসতবাড়িতে পুনর্বাসন নয়, বাঙালি শরণার্থী হিসেবে ক্যাম্পে রাখার প্রস্তুতি নিতে চলছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালের অক্টোবরের আগে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, তাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে তারা কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না।
 
রাখাইনে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে : ইইউ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বর নির্যাতনকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন ইইউ কমিশনের ত্রাণ কার্যক্রমের প্রধান ক্রিস্টোস স্টাইলিয়ানডেস। এর আগেও রাখাইনের সহিংসতাকে একই খেতাব দিয়েছিলেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
 
গত শুক্রবার ইউরোনিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে দুই দিনের বাংলাদেশ সফরে উদ্বাস্তু শিবিরে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের যে চাহিদা দেখেছেন তাতে তিনি স্তম্ভিত।
 
স্টাইলিয়ানডেস বলেন, ‘যেকোনো ব্যক্তির মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার হরণ হবে এমন নিশ্চয়তা চাই আমরা মিয়ানমারের সরকারের কাছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব গুতেরেসের সাথে আমি একমত যে মিয়ানমারের এ পরিস্থিতি জাতিগত নিধন।’
 
গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধের হামলায় দেশটিতে নারী-শিশুসহ নিহত হয়েছেন বহু রোহিঙ্গা। ২০১২ সালের পর অঞ্চলটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ এ সহিংসতায় রোহিঙ্গাদের হত্যার পাশাপাশি তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সব শেষ গত সপ্তাহে জানা গেছে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা জমির ধানও কেটে নিচ্ছে দেশটির সরকার।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বর নির্যাতনকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন ইইউ কমিশনের ত্রাণ কার্যক্রমের প্রধান ক্রিস্টোস স্টাইলিয়ানডেস। এর আগেও রাখাইনের সহিংসতাকে একই খেতাব দিয়েছিলেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
 
গত শুক্রবার ইউরোনিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে দুই দিনের বাংলাদেশ সফরে উদ্বাস্তু শিবিরে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের যে চাহিদা দেখেছেন তাতে তিনি স্তম্ভিত। স্টাইলিয়ানডেস বলেন, ‘যেকোনো ব্যক্তির মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার হরণ হবে এমন নিশ্চয়তা চাই আমরা মিয়ানমারের সরকারের কাছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব গুতেরেসের সাথে আমি একমত যে মিয়ানমারের এ পরিস্থিতি জাতিগত নিধন।’
 
গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধের হামলায় দেশটিতে নারী-শিশুসহ নিহত হয়েছেন বহু রোহিঙ্গা। ২০১২ সালের পর অঞ্চলটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ এ সহিংসতায় রোহিঙ্গাদের হত্যার পাশাপাশি তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সব শেষ গত সপ্তাহে জানা গেছে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা জমির ধানও কেটে নিচ্ছে দেশটির সরকার।
 
সূত্র: নয়া দিগন্ত
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন