শ্রীনগর সীমান্তহাট: সমস্যার অন্ত নেই, তবুও দু’দেশের মানুষের মাঝে সীমাহীন আনন্দ

Ramgarh 15 (1) copy
নিজাম উদ্দিন লাভলু, সীমান্তহাট থেকে ফিরে:
চট্টগ্রামের বাঁশখালির কণিকা দাস স্বামী ও দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে এসেছেন ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ত্রিপুরার সাব্রুমের শ্রীনগর সীমান্ত হাটে। উদ্দেশ্য কেনাকাটা নয়। এসেছেন শুধুমাত্র আপনজনের সাথে একটুু দেখা করা, কথা বলা, কিছুটা সময় এক সাথে কাটানো। তাঁর আপনজন ভারতের আসাম রাজ্যের নাগরিক। সুদূর আসাম থেকে কাকা সুধীর রঞ্জন স্বপরিবারে এ হাটে এসেছেন। দীর্ঘ ৩০ বছর পর তাদের দেখা সাক্ষাৎ।

জনাকীর্ণ এ হাটের এক কোণে দুটি পরিবার একে অপরকে কাছে পেয়ে আনন্দোশ্রুতে ডুবে থাকেন খানিকক্ষণ। দুই দেশের এ দুইটি পরিবারের মতো অসংখ্য মানুষ এ সীমান্তহাটে ছুটে আসেন আপনজন, আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে। শুধু বিকিকিনি নয়, সীমান্তের দুই পাড়ের আপনজনদের কাছে এ সীমান্ত হাট এক অপূর্ব মিলন কেন্দ্র। তাই হাটের পাহাড়সম সমস্যাও যেন আনন্দের স্রোতে ভেসে যায় দুই দেশের মানুষের কাছে।

গত মঙ্গলবার ছাগলনাইয়া শ্রীনগর সীমান্ত হাট সরেজমিনে পরিদর্শন করে এমন চিত্রই দেখাগেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-ভারত দু’দেশের নোম্যান্স ল্যান্ডে চালু হয় সীমান্ত হাটটি। কাঁটাতারের বেড়ায় সুরক্ষিত এ হাট  সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার বসে। বাংলাদেশের ২৭জন ও ভারতের ২৭জন লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যবসায়ী আছে এ হাটে। নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ছাড়াও নানান ধরণের মাছ বিকিকিনি হয় হাটে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি’র পাস কাউন্টার হতে ২০টাকায় প্রবেশ পাস সংগ্রহ করে যে কেউই যেতে পারে হাটে। পাস কাউন্টার ছাড়াও হাটের গেইটে রয়েছে বিজিবির একটি চেক পোস্ট। একইভাবে ভারতীয় অংশেও রয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের দু’টি পোস্ট। ওখানেও নির্দিষ্ট ফি দিয়ে প্রবেশ পাস সংগ্রহ করে সেদেশের নাগরিকরা আসেন এ হাটে। সকাল ৯টা হতে বিকাল ৪ অব্দি চলে হাটের কার্যক্রম।

সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ছাগলনাইয়া করেরহাট সড়কের পাশের অবস্থিত বিজিবির পাস কাউন্টারে মঙ্গলবার ভোর থেকেই শত শত নারী, পুরুষের লম্বা লাইন। পাস প্রার্থীদের এ প্রচণ্ড ভীড় সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় দায়িত্বরত বিজিবির সদস্যদের। একই চিত্র দেখা গেছে, সীমান্তের ওপারে শ্রীনগর অংশে।

দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার অমরপুর মহকুমা থেকে আসা স্কুল শিক্ষক কার্তিক দাস বলেন, লাইনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর পাস হাতে পেয়েছি। লাইনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে শুকিয়েছি। হাটে প্রবেশের সাথে সাথে সব কষ্ট, দুর্ভোগ দূর হয়ে গেছে। তিনি বলেন, হাটের ভিতর কোন বাধা নেই, নেই কোন সীমানা। কেনাকাটায় চলে দু’দেশেরই মুদ্রা। এখানে কে ভারতীয়, কে বাংলাদেশি এ পরিচয়ের গুরুত্ব নেই কারো কাছে। সবাই এ হাটের ক্ষণিকের অতিথি। এটাই সবার পরিচিতি।

নো ম্যান্স ল্যান্ডের শূন্য রেখার বাংলাদেশ অংশে ও ভারতীয় অংশে রয়েছে কয়েকটি শেড। শেডগুলোতেই বসে দুদেশের অস্থায়ী দোকান। বাংলাদেশ অংশের মাছের শেডে সব ভারতীয় নাগরিকদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেছে। ইলিশ, টেংরা, চিংড়ি, রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন প্রকার মাছ বিক্রি হয় এখানে। অন্যদিকে, প্রসাধনী ও স্টীলের তৈজস সামগ্রী, শাড়ি, থ্রি পিচের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় ছিল বাংলাদেশী ক্রেতাদের।

ব্যবসায়ীরা জানান, এ হাটে মুদ্রার বিনিময় হার বাংলাদেশি একশ টাকায় ভারতীয় ৮০রুপি। ত্রিপুরার কৃষ্ণ নগর থেকে আসা শংকর দত্ত জানান, ভারতীয়দের কাছে শুটকি, মাছ, কাঁকড়া ও মেলামাইন সামগ্রীর বেশ চাহিদা রয়েছে। কিন্তু  বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এসবের চাহিদা মেটাতে পারেন না।

সরেজমিনে ঘুরে ও দুদেশের আগুন্তকের সাথে আলাপ করে হাটের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানাগেছে। ত্রিপুরার শান্তি বাজারের নমিতা দাস, ফেনীর রোকসানাসহ কয়েকজন মহিলা জানান, দূরদূরান্ত থেকে লোকজনদের একটু বিশ্রাম নেয়া বা বসার কোন ব্যবস্থা নেই। শৌঁচাগার থাকলেও পানির অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী। এতে মহিলাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় বেশী।

এছাড়া মেডিকেল সেন্টার, উপাসনালয়, খাবারের হোটেল স্থাপন ও একদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে অন্তত: দুই দিন হাট খোলার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। বিজিবি ও বিএসএফের চেকিং এবং পাস কাউন্টারে দুর্ভোগ লাঘবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো ও কাউন্টারে পাস প্রার্থীদের জন্য ছাউনী নির্মাণেরও দাবি জানানো হয়।

ত্রিপুরার শিলাছড়ি থেকে আসা শিক্ষক উত্তম চাকমা ও সীতাকুন্ডের নুরুল আফছার বলেন, হাটের পণ্য সামগ্রীর মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য তদারকির ব্যবস্থা দরকার।

ছাগলনাইয়ার স্থানীয় সাংবাদিক নূরুল আফছার খন্দকার জানান, ছাগলনাইয়া করেরহাট সড়ক হতে সীমান্তহাটের সংযোগ রাস্তাটি ব্রিক সলিং বা কার্পেটিং করা এবং হাটের গেইটের পাশে গাড়ি পাকিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি।

এদিকে সীমান্ত হাট পরিদর্শনে আসা ত্রিপুরার বিধায়ক শ্রীমতি রীতা কর মজুমদার হাটের নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘হাটটি চালু হল মাত্র ৪/৫ মাস আগে। আর এ হাটে দুদেশের মানুষের এত বেশী সমাগম হবে তাও চিন্তায় ছিল না। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সমস্যাগুলো অবশ্যই সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

সপ্তাহে দুদিন হাট বসার দাবির ব্যাপারে তিনি বলেন, দুদেশের কর্তৃপক্ষ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবেন।

ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, সীমান্তহাটের সংযোগ রাস্তা পাকাকরণের টেন্ডার হয়েছে। সহসা কাজ শুরু হবে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সমস্যাও সমাধানের উদ্যোগ রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন