সবুজ পাহাড়ে বারুদের আগুনে প্রতিদিন পুড়ছে অগুণতি মানুষ

Khagrachari Picture 11-10-2013

এইচ এম প্রফুল্ল:

তিন সশস্ত্র সংগঠনের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে  সবুজ পাহাড়ে বারুদের আগুনে প্রতিদিন পুড়ছে অগুণতি মানুষ। জুমের আগুনে পোড়ে পাহাড়-বন। আর ভ্রাতৃঘাতি অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষ এমনকি অবুঝ শিশুরাও। গত কয়েক বছরের ভ্রাতিঘাতি সংঘাতে অসংখ্য মানুষের হতাহতের ঘটনা পাহাড়ে বাড়িয়ে দিয়েছে উদ্বেগ¦ -উৎকন্ঠা। শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ের তিন গ্রুপের আঘাতে অন্তত ৬ শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তিন সংগঠনের সহিংসতা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ের সম্প্রতির উপরও আঘাত হানছে।

পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনকারী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা’র নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সাথে পূর্নস্বায়ত্তশাসনপন্থী “ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং  সন্তু লারমা’র সাথে দ্বিমত পোষণকারী জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) অংশের সশস্ত্র সদস্যদের সাথে চলছে বছরের পর বছর চলছে এই ভ্রাতিঘাতি সংঘাত। তিন সশস্ত্র গ্রুপের সংঘাতে শুধু পাহাড়িরা প্রাণ হারাচ্ছে না, নিরীহ বাঙালীদেরও জীবন দিতে হচ্ছে। আর সে সাথে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি।

চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ী জনগোষ্ঠির সর্বস্তরের মানুষ এই সংঘাতের অবসান চাইলেও অবৈধ অস্ত্রেও অত্যধিক ব্যবহার এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ। অথচ, প্রতিটি খুনের ঘটনার পর পরই কোন না কোন পরিবার হারাচ্ছেন স্বজন অথবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম অভিভাবকটিকে।
২০১১ সালে ১৩ এপ্রিল পাহাড়ের মানুষ যখন ব্যস্ত বৈসাবি উৎসব পালনে ব্যস্ত ঠিক তখনি বাঘাইছড়িতে গর্জে উঠে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র। উপজেলার দুর্গম কদমতলী গ্রামে সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে  ঘুমন্ত অবস্থায় বাবা চিজিমনি চাকমার সাথে প্রাণ হারায় দুই বছরের শিশু অর্কি চাকমা।  জেএসএস(এমএন) লারমা গ্রুপের দাবী নিহত চিজি মনি চাকমা তাদের দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আর এই হত্যাকান্ডের জন্য তারা জেএসএস(সন্তু) গ্রুপকে দায়ী করেন।  
গত ১৪ জুলাই রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে কালাধন চাকমা(২৫) নামে স্থানীয় এক গ্রামবাসী নিহত হয়েছে। এ সময় তার কোলে থাকা ১৮ মাসের  শিশুপুত্র আদর্শ চাকমা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। শিশুটি এখন খাগড়াছড়ি হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। জেএসএস(এমএম) লারমা গ্রুপ এ হামলার জন্যও জেএসএস(সন্তু) গ্রুপকে দায়ী করেছে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাত সোয়া ৯টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা থানার বটতলী হাজী পাড়ায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারমা সংগঠন ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক কংজাই প্রু মারমা (৪৫) ও তার চার বছরের শিশুপুত্র সাচিং মারমা আহত হয়। আহতদের গুইমারা সেনা রিজিয়নের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, রাত সোয়া ৯ টার দিকে মারমা সংগঠন ঐক্য পরিষদের গুইমারা থানা শাখার  সাংগঠনিক সম্পাদক কংজপ্রু মারমা তার শিশুপুত্র সাচিং মারমাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। এ সময় চার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী দু’টি মোটরসাইকেলে এসে জানালা দিয়ে গুলি চালালে পিতা ও পুত্র গুলিবিদ্ধ হয়।

এখানে শেষ নয়, তিন সংগঠনের আধিপত্য লড়াইয়ে পাহাড় জুড়ে প্রতিপক্ষের হামলা, হত্যা-অপহরণের পাশাপাশি ব্যাপক চাঁদাবাজিরও অভিযোগ রয়েছে। তাদের হাতে নিরীহ পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালীরাও শিকার হচ্ছে। যদিওবা বাঙালীদের ক্ষেত্রে তেমন আওয়াজ হচ্ছে না।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ির তাইনদং-এ একটি সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসের জের ধরে প্রায় অর্ধ শতাধিক নিরহ পাহাড়ির বাড়ী-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এমনিভাবে ২০১১ সালে রামগড়ের বড়পিলাকে প্রাণ হারিয়েছে তিন নিরীহ বাঙালী শ্রমিক। পুড়েছে শতাধিক পাহাড়ির বাড়ী। ২০১০ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি জেলা সদরে প্রাণ হারায় পৌর সভার কর্মচারী আনোয়ার হোসেন। তারই জের ধরে শতাধিক বাড়ী-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। যার ক্ষত এখনো শুকায়নি।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) সভাপতি নমিতা চাকমার অভিযোগ, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা, খুন, গুম ও অপহরণসহ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য শান্তিপ্রিয় পাহাড়ি নেতারা বার বার আহবান জানালেও বিবদমান সংগঠনগুলো কর্ণপাত করছে না।

তিন সশস্ত্র সংগঠনের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে পাহাড়ী অধ্যুষিত জনপদে তীব্র আতংকের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। শুধু তাই নয়, কোন হত্যাকান্ডের-ই সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় দুর্গম এলাকার পাহাড়ী গ্রামগুলো চিহ্নিত অবৈধ অস্ত্রধারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তবে এ নিয়ে তিন সংগঠনের রয়েছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য।

সহিংস ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সুধাসিন্ধু খীসা বলেন, এক কথায় এ ধরনের ভ্রাতৃঘাতি  সংঘাত অগ্রহণযোগ্য এবং নিন্দনীয়। কিন্তু পাহাড়ে শাসক গোষ্ঠির ক্রীড়নক হয়ে কারা এইসব হত্যাকান্ড চালাচ্ছে বা কার নির্দেশে এসব হচ্ছে তা, সাধারণ পাহাড়ীদের কাছে পরিষ্কার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্ষীয়াণ এই রাজনীতিক সন্তু লারমা’র দিকে ইঙ্গিত করে আরো বলেন, এ পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কথা বলেই তাঁরা তিন পার্বত্য জেলায় নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ)-র খাগড়াছড়ি জেলার প্রধান সংগঠক প্রদীপন খীসা বলেন, ‘‘সন্তু লারমা, প্রকাশ্য সভা সমাবেশে ইউপিডিএফ নির্মুলের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারই ধরাবাহিকতায় এসব হত্যাকান্ড। তিনি দাবী করেন, সংঘাত বন্ধের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে বারবার সন্তু লারমার কাছে আহ্বান জানানো হলেও তিনি সাড়া না দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার মতো ঘৃন্যতম পথ বেছে নিয়েছেন।

পক্ষান্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির(সন্তু) সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিকে কেউ কেউ ভ্রাতৃঘাতি বললেও বাস্তবে তা নয়। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার সুযোগে ইউপিডিএফ সশস্ত্র তৎপরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সমস্যা থাকবে না। তিনি বলেন, চুক্তি বিরোধীতার নামে কোন কোন মহল পাহাড়ে সংঘাত জিইয়ে রাখতে চাইছে। ইউপিডিএফ’র সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সন্ত্রাসের পথ পরিত্যাগ করলে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে। তবে  পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চান।

এদিকে পাহাড়ে তিন সংগঠনের সহিংস তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মিডিয়ার কাছে মুখ খুলতে রাজি নন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “সবুজ পাহাড়ে বারুদের আগুনে প্রতিদিন পুড়ছে অগুণতি মানুষ”

  1. পাহাড়ের অসাধারণ বাস্তবতা তুলে ধরার জন্য লেখক ও প্রকাশককে ধন্যবাদ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন