সশস্ত্র ৫ সন্ত্রাসী গ্রুপের নিকট জিম্মি পাহাড়

fec-image

শান্ত তিন পার্বত্য জেলাকে অশান্ত করে তুলছে সশস্ত্র ৫টি সন্ত্রাসী গ্রুপ। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্বার্থ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের গোলাগুলি হচ্ছে। শান্তিচুক্তির চুক্তির ২৪ বছরে সর্বোচ্চ বরাদ্দে পাল্টে যাওয়া এ অঞ্চলে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে খুন করেছে আড়াই হাজারের বেশি। ৩০ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত এসব অঞ্চলে পাহাড়ি বাঙালি সবাই এসব সশস্ত্র গ্রুপে জিম্মি। মূলত বছরে হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজির আধিপত্য নিয়েই চলছে সংঘাত। আর এসব সংঘাতে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে পুরো পাহাড়ি এলাকা।

স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, তিন পার্বত্য এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মূলত পাঁচ সন্ত্রাসী সশস্ত্র সংগঠন। এরা হলো জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক এবং সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে এমএনপি (মগ গণতান্ত্রিক পার্টি)।

এই সংগঠনগুলোই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারও বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রায় ৪০০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে একে পরের প্রতি। গহিন অরণ্যে একেকটি গ্রুপ ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত থাকে। এরা কাপ্তাই লেকের পর্যটনবাহি নৌকা, মালবাহী ট্রলার, বাসা বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা নেয়। ন্যূনতম ২০০ থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি হয়। বছরে এর পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়।

স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, শান্তিচুক্তির ২৪ বছরে সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পে পাল্টে যেতে শুরু করেছে এ অঞ্চলের জনপদ। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভাটসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে সেনাবাহিনী। মূলত তাদের এ লড়াইয়ে এ জনপদ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে প্রায়ই অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। আধিপত্যের লড়াইয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে হরহামেশাই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও খুনাখুনির ঘটনা। সর্বশেষ বান্দরবানের রুমায় আঞ্চলিক সংগঠনের সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির তৎপরতা, তাদের সশস্ত্র হামলায় সেনাবাহিনীর একজন সদস্য নিহত এবং একজন আহত হওয়ার ঘটনা পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিষয়গুলোকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো আরও বলছে, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলভিত্তিক পাঁচটি উপজাতীয় সংগঠনের হাতে প্রায় ৪ হাজারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র মজুত রয়েছে। ধীরে ধীরে এসব সংগঠনে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ে কোন্দলে মাঝেমধ্যেই গর্জে উঠে ভয়ঙ্কর ওইসব অস্ত্র। অস্ত্রের গর্জন ছড়িয়ে শান্তির পাহাড়কে করছে তারা অশান্ত। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ব্যাপক হারে প্রাণ যাচ্ছে ওইসব সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ পাহাড়িদের। ২০১৮ সালের ৩ মে আধিপত্যের কোন্দলে ‘ব্রাশফায়ার’ করে জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করে ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা।

পরদিন ৪ মে শক্তিমানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজনকে ‘ব্রাশফায়ার’ করে হত্যা করে ইউপিডিএফের (মূল) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। একই বছরের ২ মে ইউপিডিএফের সাবেক সদস্য উজ্জ্বল কান্তি চাকমাকে জেএসএসের (সংস্কার) সশস্ত্র ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করে। কয়েকদিন পর ২৮ মে সাজেক থানার করল্লাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) ক্যাডারদের গুলিতে ইউপিডিএফের (মূল) সদস্য স্মৃতি চাকমা, সুশীল চাকমা ও অটল চাকমা নিহত হন। এই ধারাবাহিকতায় এখনো মাঝেমধ্যেই রক্ত ঝরে পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে।

এ কারণে পরিস্থিতি বিবেচনায় সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলোতে নতুন করে আবারো সেনা মোতায়েন জরুরি বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আপাতত পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্পে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ‘আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)’ এবং আনসার ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে (এএফডি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে পার্বত্য তিন জেলা থেকে সেনাবাহিনীর ৩৩৪টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু যে এলাকা থেকেই ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেখানেই সুযোগ নিয়েছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। আধিপত্য বাড়াতে পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পগুলো ঘিরেই আস্তানা গড়েছে পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠনগুলো।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা মনে করি, পাহাড়ে কিছু সমস্যা আছে। এখানে ভেতরে ভেতরে অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র কাজ করে। সেখানে আর্মি ক্যাম্প রয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজ করছে। অচিরেই সেখানে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সার্বিক আইনশৃঙ্খলার জন্য পাঠানো হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি হওয়ার পর সরকার আন্তরিক হয়ে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৩৩৪টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে ২১৮টি সেনাক্যাম্প রয়েছে; কিন্তু যেখান থেকেই সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে পক্ষান্তরে সেখানেই ইউপিডিএফ ও জেএসএসসহ আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ভয়াবহভাবে বিস্তার ঘটেছে। এমনকি কৌশলে কিছু পাহাড়ি মানুষকে ব্যবহার করে ধর্মীয় উপাসনালয় তথা বৌদ্ধমন্দির বা বিহার, ভাবনা কেন্দ্র, কিয়াংঘর ও স্কুলঘরসহ নানা নামে-বেনামে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার করা ক্যাম্পের ভূমিগুলো দখল করেছে সশস্ত্র সংগঠনগুলো। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করেছে যে, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রত্যাহার করা ক্যাম্পগুলো পুনরায় চালু করার বিকল্প দেখছেন না নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ বলেন, নিঃসন্দেহেই পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলোতে সেনা মোতায়েন জরুরি। কেননা এখানে অস্ত্র সমর্পণের চুক্তির পরও সেটা যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। ওখানে যে চারটি অংশকে (জেএসএস-মূল, জেএসএস-সংস্কার, ইউপিডিএফ-প্রসীত, ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) দেখা যাচ্ছে তারা কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত। তাদের ভেতরেও তারা এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে অস্ত্রের মহড়া দেখিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা বিধান করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেসব এলাকা থেকে আর্মির উপস্থিতি কমে যাচ্ছে সেখানেই সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেনাবাহিনীর ওপরও হামলার ঘটনা ঘটছে। সেনাবাহিনীর ওপর হামলা যে অঞ্চলে হলো সেই বান্দরবানে কিন্তু তুলনামূলকভাবে শান্ত পরিবেশ ছিল; কিন্তু হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এর পেছনে কারা কাজ করছে, এটা সবার কাছেই পরিষ্কার। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে বান্দরবান জেলা নাগরিক পরিষদের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. মুজিব রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন আর শান্তিচুক্তি নিয়ে ডায়লগ করা, বাস্তবায়ন করার সময় নেই। এখন ক্যানসার হয়ে গেছে, সার্জিক্যাল চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। অপারেশন করে ক্যানসারমুক্ত করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়েছি, বিষয়টি জাতীয় সংসদে তুলে ধরতে। দেশবাসী জানুক। পার্বত্য অঞ্চলে প্রকৃতপক্ষে কী হচ্ছে।

মুজিব রহমান বলেন, ৫ ফেব্রুয়ারি আমরা বান্দরবান শহরে সেনাসদস্যকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছি। সেখানেও আমরা একই কথা বলেছি। আমাদের দাবি হচ্ছে, সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলো অতিসত্বর চালু করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিটি উপজেলায় সেনা জোন করে পর্যাপ্ত ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ বাহিনীকে হেলিকপ্টার ও অত্যাধুনিক অস্ত্র-সরঞ্জাম দিতে হবে। র্যাবের কার্যক্রম চালু করতে হবে। ১৭৫ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত সড়ক তৈরি করে আধা কিলোমিটার পরপর বিজিবির ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি অব্যাহত রাখতে হবে যৌথবাহিনীর সমন্বিত অভিযান। যেখানে দেশরক্ষা বাহিনীর (সেনাবাহিনী) সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়, সেখানে স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়ে যায়। সুতরাং এখনই এর মূলোৎপাটন করা উচিত।’

জানা গেছে, দেশের পার্বত্য অঞ্চলে এসএমজি (সাব-মেশিনগান), একে-৪৭ কিংবা একে-২২ রাইফেলের মতো এমন ধরনের বিপুলসংখ্যক অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ের নিরীহ বাঙালি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করতে এবং ভূমিদখলসহ পার্বত্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের রাখতে এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার ও মজুত করছে পার্বত্য অঞ্চলের পাঁচটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। এরা গহিন অরণ্যে গড়ে তোলেছে ঘাঁটি। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করা গোয়েন্দাদের ধারণা মতে, পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের হাতে বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়ে থাকে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন