সাইরু ম্রোর অমর প্রেমকাহিনির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলিঙ্গনরত দুটি গাছ

প্রেমিক হারানোর বিরহে পাহাড় চুড়ো থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেওয়া ম্রো তরুণী ‘সাইরু’ আজ নেই। কিন্তু তাঁর অমর প্রেমের সাক্ষী হয়ে আলিঙ্গনরত অবস্থায় পাহাড় চুড়োয় দাঁড়িয়ে আছে দুটি বনবৃক্ষ। এর একটি ফুলসুমারি অন্যটি ধারমারা গাছ। বান্দরবানের চিম্বুক রোডের সেই এলাকার নাম এখন ‘সাইরু পয়েন্ট’। জানাচ্ছেন : মনু ইসলাম, বান্দরবান


সাইরুর সেই প্রেম কাহিনি ম্রো যুবক-যুবতীদের মুখে মুখে। নিজের প্রেমের গভীরতা বোঝাতে তাঁরা বলেন, সাইরুর মতোই আমি তোমাকে ভালোবাসি। সবার মুখে মুখে সাইরু এবং তাঁর প্রেমিক যুবকের সেই প্রেম কাহিনি বর্ণিত হতে হতে নানাদিকে এর ডালপালা গজাচ্ছে।

কেউ বলছেন, সাইরুর আত্মাহুতির কথা জানতে পেরে প্রেমিক যুবকও একই পাহাড় চুড়ো থেকে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। কেউ বলে পাগল বেশে অনেক দিন ঘুরে ঘুরে সেই যুবকও একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন।

সাইরুর আত্মাহুতি দেওয়া বান্দরবানের চিম্বুক রোডের সেই জুম পাহাড় এখন ‘সাইরু হিল রিসোর্ট’ নামে পরিচিত। বিত্তবান বন্ধুদের সহায়তায় মৌজা হেডম্যান রাংলাই ম্রো বছর তিনেক আগে এ রিসোর্ট গড়ে তোলেন।

বান্দরবান জেলা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অবকাশ কেন্দ্রের বিনিয়োগকারীরা বিত্তশালী হলেও রুচিহীন নন। সাইরুর এই প্রেম কাহিনিকে মর্যাদা দিতে গাছের গোড়ায় গোলাকৃতির শান বাঁধিয়ে তারা স্থানটিকে একটি চমৎকার দর্শনীয় স্থানে রূপ দিয়েছে।

এই রিসোর্টের প্ল্যানার, আর্কিটেক্ট এবং প্রকৌশলী ওয়াহিদুজ্জামান জানান, সাইরুর অমর প্রেমের কাহিনিকে বাঁচিয়ে রাখতে এক পাশে গভীর খাদ, যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন সাইরু, অন্যপাশে আলিঙ্গনরত দুটি বিশাল বৃক্ষকে অবিকৃত রেখে এই গোলাকার প্ল্যাটফরমটি নির্মাণ করা হয়েছে।

তিনি জানান, যাঁরাই সাইরু রিসোর্টেও অতিথি হয়ে আসেন, তাঁরা সবাই প্রায় প্রতিদিনই একবার এখানে এসে বসেন। পুরো প্রকল্প এলাকার মধ্যে এটিই যেন সবচেয়ে প্রিয় স্থান।

স্থপতি ওয়াহিদ বলেন, ‘‘আমরা এর নাম দিয়েছি, ‘সাইরু জিরো পয়েন্ট’।’’

ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘সাইরু রিসোর্টের রিসিপশনের দেয়ালে বড় করে আমরা সাইরুর প্রেম কাহিনি ইংরেজি ভাষায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছি।’

অন্যদিকে আশপাশের সব এলাকার ম্রো জনজাতি বিশ্বাস করে, প্রেমিকা সাইরু দাঁড়িয়ে আছেন ফুলসুমারি গাছ হয়ে। তাঁকে আলিঙ্গন করে আছে ধারমারা গাছরূপী নাম না জানা সেই প্রেমিক যুবক।’

ফুলসুমারি গাছকে ম্রো ভাষায় বলা হয় ত্রুং (ঞত্ঁহম) এবং ধারমারা গাছকে বলা হয় ‘রনখা (জড়হশযধ)।’ কেউ কেউ এর আরো একটি আলাদা নাম দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ত্রুং-রুমখা তং (ত্রুং-রুমখা প্রেমের পাহাড় চূড়া)।

রাংলাই ম্রো জানান, সাইরু এবং নাম না জানা সেই যুবক ছিল আলাদা আলাদা জাতিসত্তার মানুষ। তাঁরা একজন আরেকজনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও ভিন্ন জাতিসত্তা হওয়ার কারণে এই প্রেম সফল না হয়ে ট্র্যাজিক প্রেমে পরিণত হয়।

রাংলাই জানান, ধনী এবং সম্পদশালী হওয়ায় সাইরু এবং তার প্রেমিকের পরিবার স্থানীয়ভাবে ‘রাজ পরিবার’ নামে পরিচিত ছিল। প্রথমদিকে তাঁরা এই প্রেমকে বাধা দিতেন না। ফলে দিনে দিনে এই প্রেম অনেক গভীরে পৌঁছায়। কিন্তু প্রেমে বাধা না দিলেও জাতি ভিন্ন হওয়ায় দু’পরিবারের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের মধ্যে বিয়ে মেনে নিতে পারেননি।

তাঁদের মধ্যকার প্রেম এতটাই প্রবল ছিল, একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারতেন না। তাই প্রতিরাতে সাইরুদের জুম পাহাড়ে গোপনে তাঁরা মিলিত হতেন।

কিন্তু হঠাৎ করে যেন সব উলট-পালট হয়ে গেল। সাইরুর প্রেমিক যুবক আর দেখা করতে আসেন না জুম পাহাড়ে। একা একা পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে

আরেক প্রান্তে হেঁটে হেঁটে বিরহের গান গেয়ে পরদিন ভোরে ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফিরতেন সাইরু।

একদিন সাইরু খবর পেলেন, মা-বাবার চাপে পড়ে প্রেমিক যুবক নিজ জাতির একজনকে বিয়ে করে সুখী জীবন কাটাচ্ছেন। এই সংবাদে সাইরুর মাথায় বাজ পড়ে। সুখের ঘর বাঁধার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়।

সাইরু ভাবেন, ‘বন্ধু ছাড়া বাঁচি কি করে?’

এ ভাবে কেটে যায় কত দিন, কত রাত। সাইরুর কান্নায় গাছের পাতারা ঝরে যায়। পাখির গান বন্ধ হয়ে যায়। বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়।

একরাতে জুম পাহাড়ে এসে আগের জায়গায় বসে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে সাইরু। অনেক দূর থেকেও গ্রামবাসী তাঁর কান্নার শব্দ শোনে। এরপর ভোরের দিকে পাহাড় চূড়া থেকে গভীর খাদে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন সাইরু।

এদিকে অনেকদিন সাইরুর কোনো খোঁজ না পেয়ে গ্রামবাসী জুম পাহাড়ে এসে দেখেন সেখানে সাইরু নেই। তাঁদের মিলনের স্থানটিতে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে একটি ফুলসুমারি গাছ এবং আরেকটি ধারমারা গাছ।

এখনও ম্রো জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে, সাইরুর মৃত্যু হয়নি। জগেজাড়া প্রেমিক প্রেমিকার জন্যে অনুপ্রেরণা হয়ে তার আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

রাংলাই জানান, ম্রো ভাষায় ‘সাই’ অর্থ ‘পবিত্র’ এবং ‘রু’ অর্থ ‘আত্মা।’ সাইরুর এই প্রেম কাহিনিকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি তাঁদের রিসোর্টের নাম দিয়েছেন ‘সাইরু।’

এদিকে সাইরুতে থেকেছেন, এমন অনেকে বলছেন, গভীর রাতে তাঁরা কোনো এক নারী কণ্ঠের গান শুনতে পেয়েছেন! তাঁরাও বিশ্বাস করেন, হয়তো সাইরু এখনো বেঁচে আছেন।

– সূত্র: কালের কণ্ঠ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন