“২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এ উন্নীতকরণের ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুসারে এজেন্ডা নির্ধারণ এবং প্রতিটি মন্ত্রণালয়, দপ্তর তাদের কাজ শুরু করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্ন্যান্স, স্মার্ট সোসাইটি। এতে বুঝা যে, নাগরিকদের শতভাগ সাক্ষর, শিক্ষিত এবং তথ্য প্রযুক্তিতে জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে।”

স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সাক্ষরতা অত্যাবশ্যকীয়

fec-image

Promoting literacy for a world in transition: Building for sustainable and peaceful societies. এ প্রতিপাদ্যে আজ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সমাজের কাছে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরতে ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ৮ সেপ্টেম্বর তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৬৭ সাল থেকে দিবসটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রে দিবসটি উদ্যাপিত হয়। সাক্ষরতা বলতে সাধারণত পড়তে ও কম করে হলেও একটি ভাষায় লিখতে পারার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়।

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগ সর্বোচ্চ ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বনিন্ম সাক্ষরতার হার ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ৭৭ দশমিক ৫৭, রাজশাহী বিভাগে ৭১ দশমিক ৯১, রংপুর বিভাগে ৭০ দশমিক ৭৫, সিলেট বিভাগে ৭১ দশমিক ৯২, খুলনা বিভাগে ৭৫ দশমিক ২ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে মোট সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে পুরুষ ৭৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ, নারী ৭৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ, তৃতীয় লিঙ্গ ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে একটি বিশাল এলাকা নিয়ে দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল। এখানে (খাগড়াছড়ি ৭১.৭৩%, রাঙ্গামাটি ৭১.৩৩% এবং বান্দরবান ৬৩.৬৪%) সাক্ষরতার হার প্রায় জাতীয় সাক্ষরতার (৭৪.৬৬%) হারের কাছাকাছি, এমনকি ময়মনসিংহ বিভাগের সাক্ষরতার (৬৭.০৯%) হারের চেয়ে বেশি।

নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নারী শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের সাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১১ সালে নারী-পুরুষ মিলে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যারা পড়তে, লিখতে, বুঝতে ও গণনা করতে পারে তাদের নিয়ে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অন্য একটি জরিপ করে, যার নাম দেয়া হয় ‘প্রায়োগিক সাক্ষরতা জরিপ’। এ জরিপ মতে, দেশের ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৯৭। এ ছাড়া ১৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের ক্ষেত্রে এ হার ৬০ দশমিক ৭৭। ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায়োগিক সাক্ষরতায় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে নারীরা। জরিপে দেখা যায়, গ্রামের তুলনায় শহরে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার বেশি। পুরুষদের (৭-১৪ বছর) মধ্যে যেখানে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ৬৯ দশমিক ৬৭, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রের এ হার ৭৬ দশমিক ৪২।

২০২৩ সালের জরিপে প্রথমবারের মতো সাত বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের জরিপ করা হয়েছে। সাক্ষরতার হার যাচাইয়ে নির্বাচিত প্রত্যেক ব্যক্তির ১০০ নম্বরের পরীক্ষার মধ্যে যারা ন্যূনতম ৫০ নম্বর পেয়েছে, প্রায়োগিকভাবে তাদের সাক্ষর হিসেবে ধরা হয়েছে। এ কাজে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর আগে ২০১১ সালে ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের নিয়ে জরিপ চালানো হয়। তখনকার জরিপে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ছিল ৫৩ দশমিক ৭০। এই বয়সসীমা ধরলে বর্তমান জরিপে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৬৯। এর অর্থ গত ১৩ বছরে এই হার বেড়েছে ১৯ দশমিক ৯৯। (তথ্য সূত্র: বিবিএস)।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়ার হার ১৯ শতাংশ এবং কখনই ভর্তি না হওয়ার হার ২ শতাংশ। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, সারাদেশে ৮-১৪ বছর বয়সী শিক্ষা বঞ্চিত প্রায় ৪৩ লক্ষ শিশু রয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) এর সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫ এর আওতায় ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিখন কেন্দ্রের বিদ্যালয় বহির্ভূত (ঝরে পড়া এবং ভর্তি না হওয়া) ৮-১৪ বছরের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য দ্বিতীয় বার সুযোগ সৃষ্টি করে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূলধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির মেয়াদ ২০১৯-২০২৩। ৫৪টি বাস্তবায়নকারী সংস্থার মাধ্যমে ৬৩টি জেলার ৩৪৩টি উপজেলায় ৮১৫৯৬০ জন শিশুকে এ কর্মসূচির মাধ্যমে সাক্ষর করে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। (তথ্য সূত্র: উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো)। এটি মূলত প্রাথমিক এবং পরিকল্পিত শিক্ষা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালরে মধ্যে অর্জিতব্য ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’ এর ৪এ মানসম্মত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪.১এ ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেমেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে যথার্থ, মানসম্মত ও ফলপ্রসূ শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। এটি অর্জনে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। ৪.২এ ২০৩০ সালের মধ্যে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে শৈশব বিকাশ, যত্ন ও প্রাক-প্রথমিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি এবং প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য বলা হয়েছে। এ সূচক ইতোমধ্যে প্রায় শতভাগ অর্জিত হয়েছে। ৪.৩এ ২০৩০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষ সবার জন্য কারিগরি, বৃত্তিমূলক এবং উচ্চতর এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচক। এটি অর্জনে চলমান কার্যক্রমে আরও গতি আনতে হবে। ৪.৬এ ২০৩০ সালের মধ্যে যুবসহ পর্যাপ্ত হারে প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞান নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। এটিই আজকের সাক্ষরতা সংশ্লিষ্ট মূল সূচক। এটি অর্জনে সরকারের চলমান কার্যক্রমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সংগঠন কিংবা দেশগুলোর কারিগরি এবং আর্থিক সহায়তা জরুরি। দুর্গম স্থান এবং সেখানে চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে এ নিয়ে যৌথভাবে কাজ করলে সফলতা অর্জন সম্ভব।

বয়স্কদের সাক্ষর করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি অর্জনে সর্বপ্রথম প্রয়োজন সামাজিক আচরণগত পরিবর্তন (ঝড়পরধষ ইবযধারড়ঁৎ পযধহমব), জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রয়োজনে এ জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সাথে সম্পৃক্ত করে কিংবা আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের সাধ্যমে সাক্ষরতায় উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এ উন্নীতকরণের ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুসারে এজেন্ডা নির্ধারণ এবং প্রতিটি মন্ত্রণালয়, দপ্তর তাদের কাজ শুরু করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্ন্যান্স, স্মার্ট সোসাইটি। এতে বুঝা যে, নাগরিকদের শতভাগ সাক্ষর, শিক্ষিত এবং তথ্য প্রযুক্তিতে জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। পরিবর্তনশীল বিশ্বে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে অক্ষরজ্ঞান তথা সাক্ষরতার বিকল্প নেই।

লেখক: সহকারী তথ্য কর্মকর্তা, রামগড়, খাগড়াছড়ি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন