১৮ দিন ধরে মগনামা চ্যানেলে মাছ ধরা বন্ধ: ক্ষোভে ফুঁসছে কয়েক হাজার বেকার জেলে
নিজস্ব প্রতিনিধি.পেকুয়া:
“সাগরত জাল বোয়ানি বন্ধ গরি আঁরার পেট বেরাই লাথি মাইরগ্যে, এহন ডাহাতি গরন ছারা আঁরাত্তুন হন গতি নাই। আঁরা হন মাছর পোনা ন’ দরির, বিন্দি জাল বোয়াইয়েরে মাছ বেচি দোআ ভাত হাইর, এড়েও শান্তি ন পাইর” অর্থাৎ ‘সাগরে জাল বসা বন্ধ করে দিয়ে আমাদের পেটে লাথি মেরেছে, এখন আমাদের ডাকাতি করা ছাড়া কোন উপায় নেই। আমরা মাছের পোনা ধরছি না, বড় জাল বসিয়ে মাছ বিক্রি করে দুমুটো ডালভাত খাই, এখানেও কোন শান্তি পাচ্ছিনা।’ অত্যন্ত ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের নূইন্যা পাড়া এলাকার জেলে আহমুদুল করিম, জাফর আলম বাদশা, জেলেনী জবুরা বেগম সহ আরো অনেকে।
এলাকা ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানাযায়, গত ১৮ দিন ধরে মগনামা ও কুতুবদিয়ার মাঝামাঝি পয়েন্টে মগনামা চ্যানেলে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে পেকুয়া উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর। ইতিমধ্যে পেকুয়া উপজেলা মৎস্য অফিসার সুজয় পালের নেতৃত্বে কুতুবদিয়ার কোষ্টগার্ড অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু বিন্দি জাল সাগর থেকে তুলে নিয়ে আগুনে জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে বলেও জানা গেছে। এরপর থেকে মগনামা চ্যানেলে জাল বসানো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে।
এদিকে সরকারীভাবে সাগর থেকে মাছ ধরা বন্ধের কোন নির্দেশনা না থাকলেও ঠিক কী কারণে হঠাৎ করে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তাও জানেন না জেলেরা। এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে জেলে সম্প্রদায়। গত বুধবার সাগরে জাল বসানোর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া ও মৎস্য অফিসারের অপসারনের দাবিতে কয়েক হাজার জেলে উপজেলা পরিষদের সামনে দীর্ঘ মানবন্ধন করে। পরে জেলেরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর শওকত হোসেনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক ও প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করে।
এলাকাবাসির সাথে কথা বলে জানাযায়, রাজাখালী থেকে মগনামা পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮/২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়ীবাঁধের পাশ ঘেষে গড়ে উঠা জেলে পাড়া গুলোর অধিকাংশ অধিবাসিই সাগরে মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। রাজাখালী ইউনিয়নের আমিন বাজার, সুন্দরী পাড়া, মগনামা ইউনিয়নের শরতঘোনা, ফতেইল¬্যামার পাড়া, মওলার পাড়া, রাহাত আলী পাড়া, নুইন্যার পাড়া, সেকান্দর পাড়া, পশ্চীমকুল, জালিয়া পাড়া, চেপ্টাখালী, ডলইন্যা পাড়া, মোজার চর, কাকপাড়া, কালার পাড়া, চাইন্দার পাড়া, শুদ্ধখালী পাড়া, মরিচ্যাদিয়া, বেদরবিল পাড়া, সাতঘর পাড়া সহ বেশ কয়েকটি এলাকার প্রায় ২০ হাজার জেলে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কোন কারণ ছাড়াই মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়ায় ওই ২০ হাজার জেলে বর্তমানে বেকার সময় কাটাচ্ছেন। এতে করে জেলেদের পরিবারে যেমন নেমে এসেছে অভাব অনটন তেমনি দাদন দাতাদের চাপের মুখে অনেকটা অসহায় পড়েছে তারা। মগনামা নুইন্যা পাড়ার জেলে মো: দুলাল জানান, মাছ ধরা বন্ধ হবার পর থেকে তারা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। কারণ তারা একদিন সাগরে না গেলে আহার জুটে না। একই এলাকার জেলে মাহমুদুল করিম, বেলাল, আবদুর রহিম, শাহাব উদ্দিন, মো. হোসেন, আমির হোসেন, মানিক সহ আরো অনেকে জানান, প্রায় প্রত্যেক জেলে দাদন নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায় কিন্তু মাছ ধরতে না পারলেও দাদনের টাকা শোধ করতে হয়। তার উপর মৎস্য কর্মকর্তা মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়ে জেলেদের কাটা গায়ে নুন ছিটে দিয়েছেন। প্রত্যেক জেলে নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে জাল কিনে সাগরে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু কোষ্টগার্ড তাদের জাল নিয়ে পুড়ে ফেলায় তাদের পেটে আঘাত করা হয়েছে বলে জানান তারা।
জেলেরা জানান, সরকারী নির্দেশনা মেনে সাগরে মা মাছ ডিম ছাড়ার নির্ধারিত সময়ে এ এলাকার জেলেরা ১৮ দিন পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রাখলেও জেলেদের পূর্ণ মৌসুমে এসে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়ায় হতাশ হয়েছেন তারা। এ ঘটনায় জেলেদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিক্ষুব্দ শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মৎস্য অধিদপ্তর একতরফিয়া ভাবে মগনামা চ্যানেলে মাছ ধরা বন্ধ করে দিলেও কুতুবদিয়ার উপজেলার জেলেরা কুতুবদিয়া চ্যানেলে ঠিকই জাল বসাতে পারছেন। শুধুমাত্র পেকুয়ার জেলেদের জাল বসাতে দেয়া হচ্ছেনা বলে অভিযোগ করে তারা বলেন, পেকুয়া উপজেলা মৎস্য অফিসার দাদনদাতাদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা আদায় করতে পায়তারা করেছেন আর তা না পেয়ে জেলেদের উপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার চালাচ্ছেন।
রাজাখালী ইউনিয়নের মৎস্যজীবি নেতা আবু তাহের জানান, জেলেরা বিক্ষুব্দ হয়ে উঠলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। মগনামা ইউনিয়নের মাছ ব্যবসায়ী নুরুল আমিন ও কামাল হোসেন জানান, কোন কারণ ছাড়াই মৎস্য অধিদপ্তর সাগরে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে। জেলেদের পুনর্বাসন না করে মাছ ধরা বন্ধ করে দিলে এলাকায় চুরি ডাকাতি বৃদ্ধির পাশাপাশি আইন-শৃংখলার চরম অবনতির আশংকা রয়েছে। তারা জানান, যতই দিন যাচ্ছে জেলেরা বিক্ষুব্দ হয়ে উঠছে, আর মাছ ধরা আরো কিছুদিন বন্ধ থাকলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বলা মুশকিল। তারা পেকুয়ার মৎস্য কর্মকর্তা সুজয় পালকে দ্রুত অপসারণ করে জেলেদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানান অন্যথায় জেলেদের নিয়ে আন্দোলনে নামবেন বলে জানান তারা।
এসময় মাছ ব্যবসায়ী নুরুল আমিন, জাকের হোসেন এমইউপি, নুর মোহাম্মদ এমইউপি, জাকের উল্লাহ এমইউপি, সাবেক এমইউপি আজিজুল হক, জেলে নেতা মোজাফ্ফর আহমদ, মকছুদ, জাফর আলম বাদশা, আবু তাহের, আনোয়ার হোসেন, নাজেম উদ্দিন, আহমদুল করিম, মাহমুদুল করিম, নূর মোহাম্মদ, নুরুল আবসার, আবুল হোছাইন, নুরুল কাদের, আবদুল খালেক, আবুল হোসেন, আবুল কালাম সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে জানতে পেকুয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুজয় পালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তার নির্দেশে সাগরে জাল বসানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শত বছর ধরে জেলেরা এ পেশার সাথে জড়িত এবং এটাই তাদের রুটি রুজির একমাত্র পথ, তাদেরকে পুনর্বাসন না করে এভাবে জাল বসানো বন্ধ করে দেয়াটা অমানবিক কিনা জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, চুরি করা অপরাধ; পেটের দায়ে চুরি করা কী অপরাধ নয়?
এ বিষয়ে পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মগনামা, রাজাখালী ও উজানটিয়া ইউনিয়নের প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে সাগরে মাছ ধরার উপর। আর বিকল্প জিবীকার ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে কারো তাদের প্রধান পথ বন্ধ করে দেয়া হলে তারা বিক্ষুব্দ হয়ে উঠতে পারে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি এ বিষয়ে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।
এ বিষয়ে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মীর শওকত হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মৎস্য অধিদপ্তর তাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বন্ধ করেছে। আমি জেলেদের সাথে কথা বলে এ বিষয়টি একটি সুরাহা করার চেষ্টা করব।