আঞ্চলিক ক্ষমতার পালাবদলের মাঝে আটকা পড়েছে রোহিঙ্গারা
আফসান চৌধুরী
রোহিঙ্গা ইস্যুটি উপেক্ষা করার এখনই আদর্শ সময়, তা সুপারস্টার অ্যাঞ্জেলিনা জোলি যতই শরণার্থী শিবির দেখতে আসুন না কেন। বহু বছর ধরেই সমস্যাটা চলে আসছে, গত তিন দশকে সেটার গতি বেড়েছে, আর সবশেষ গত বছর মিয়ানমারের ভূমিকার কারণে এটা এখন সুপারস্টারদের সফরের উপযোগী হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গারা ইতিহাস আর ভূগোলের মাঝে আটকা পড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও এখানে ক্রমেই জড়াচ্ছে। মানবাধিকার ইস্যু আর আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের প্রভাব গত এক দশকে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ-রাখাইন বেল্টের মতো ‘ঝুঁকিমুক্ত’ ভূ-রাজনৈতিক এলাকায় জাতিগত নির্মূল অভিযান হলে সেটাকে অগ্রাহ্য করা এখন সম্ভব। এবং নির্মূল অভিযানকারী আর তাদের মিত্রদের এটা অনেক সাহায্য করে।
একটা সুখী, সঙ্ঘাতমুক্ত মিয়ানমার এখন বিশ্বনেতাদের কাম্য, সমস্যাপীড়িত বাংলাদেশ কোন ব্যাপার নয়। যতক্ষণ না ইসলামি জঙ্গিবাদের হুমকি তত বড় না হচ্ছে এবং সস্তা হস্তক্ষেপে এটাকে নিম্ন পর্যায়ে সীমিত রাখা সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান পরিস্থিতিকেই সবাই ইতিবাচক বিবেচনা করবে।
‘আদর্শবাদী’ ও ‘খেলোয়াড়’
সফররত কানাডার বিশেষ দূত বব রয় সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতি যে মন্তব্য করেছেন, সেখানে পরিস্থিতির আরও অবনতি থেকে নিয়ে সেটা দীর্ঘস্থায়ী ঝামেলা তৈরির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উঠে এসেছে। এখানে কোন পক্ষে জড়িত না থাকায় কানাডা শুধু সদিচ্ছা থেকে নীতিমূলক বিবৃতিই দিতে পারবে, এর বেশি কিছু নয়। তাছাড়া, যখন সুযোগ আসবে, কানাডাও তখন মিয়ানমারের সাথে ব্যবসায় নামবে এবং সেটাই চূড়ান্তভাবে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার বিষয় নির্ধারণ করবে, ‘মানবিক’ কোন বিবেচনা নয়।
যে সব খেলোয়াড় এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তারা দৃশ্যপটেই আছে – চীন, হয়তো কিছুটা আসিয়ান, আর ভারতের কিছুটা পরোক্ষ ছোঁয়া। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিও এখানে রয়েছে পরোক্ষভাবে, চীনা অর্থনৈতিক দানবের সাথে লড়াইয়েই বেশি ব্যস্ত তারা। তাই, পৃথিবী এখন এখানে ‘আদর্শবাদী’ – পশ্চিম – আর খেলোয়াড় ‘চীন+’ এর মধ্যে বিভক্ত। যেখানে এই খেলাটা খেলা হচ্ছে, সেটা হলো মিয়ানমার আর আনুষঙ্গিক হিসেবে রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, যে কোন কাজের মোটিভেশনের কারণ হলো ব্যবসায়িক সুবিধা আর কে সেখান থেকে উপকার পাবে, সেটা। আন্তর্জাতিক আইন বা নীতির মধ্যে এটাই রয়েছে, আর বহুপাক্ষিক জাতিসংঘও এটাই দেখাচ্ছে যে নতুন যুদ্ধগুলো যতটা না সামরিক, তারচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক। এক বিবেচনায় আগের যুদ্ধের চেয়ে এখানে ভণ্ডামি কম, যখন যুদ্ধের প্রকৃতি কি সেটা নির্ধারণ করতে না পারায় সেটাকে শীতল যুদ্ধ বলে চালানো হচ্ছিল।
তরল অঞ্চল
রোহিঙ্গা ইস্যু এখন যতটা না আন্তর্জাতিক, তার চেয়ে বেশি আঞ্চলিক কিন্তু সেখানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাও একটা তরল অবস্থা। চীন যেহেতু এখানে ঐতিহ্যগত ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণ করছে, পশ্চিমের তাই এখানে প্রভাব কম। যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, সেই বাণিজ্য সম্পর্কই এখানে বড় ভূমিকা রাখছে, গতানুগতিক এবং বাতিলপ্রায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবস্থান সেটা রাখছে না।
চীন-ভারত সম্পর্ক একটা প্রধান ফ্যাক্টর যেহেতু ভারত এখানে ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। চীন এই অসম প্রতিযোগিতায় আরও আগ্রাসীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ভারত সেখানে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ভারতের উদ্বেগ এখানে স্বাভাবিক কারণ তারা অনেক বড় একটা শক্তির মোকাবেলা করছে যাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে আবার অর্থনৈতিক উৎপাদন সচল রাখার মতো একটা সিস্টেমও রয়েছে। তাছাড়া বহু ধরনের রাজনৈতিক মতের কারণে চীনের গতি ব্যাহতও হচ্ছে না।
তাই, রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে যে বেতনের যুক্তিতর্ক জড়িত, সেটা চীনে নেই। আসলে ক্ষমতা পালাবদলের ধারণাটিই চীনে নেই এখন। রাষ্ট্র আর প্রশাসন সেখানে এক। তাই উৎপাদন সক্ষমতা আর তার ফলাফলের উপর তাদের মনোযোগ একনিষ্ঠ ও বাধাহীন।
ভারত অনেকটা ‘ধারাবাহিক রাষ্ট্রের’ মতো, আদি ঔপনিবেশিক আমলে যেটার সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। পারস্পরিক সুশাসনের ধারণাটি এখানে দুর্বল এবং সরকারের দায়বদ্ধতা কিছুটা রয়েছে, যেটা কিছুটা উত্তরাধিকার আর অর্জন থেকে এসেছে কিন্তু সেখানে পারস্পরিক অর্থনীতি আর উচ্চ সমৃদ্ধির ধারণার অবস্থান খুব একটা নেই।
ভারত রাজনৈতিকভাবে বহুত্ববাদী কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে সেটা নেই, যে কারণে পরিবর্তনের সাথে তারা খাপ খাইয়ে উঠতে পারে না। ভারতে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অসাম্যটা ব্যাপক, সেখানে কোন একক পরিচয়ের উপর জোর দিতে গেলে বিবাদ অনিবার্য। চীনের মতো তারাও ঐক্য খুঁজছে কিন্তু এখনও কোন ফর্মুলা বের করতে পারেনি। বিভিন্ন আঞ্চলিক বিভাজন ভারতকে অনেক জটিল করে তুলেছে এবং সেখানে শাসন করাটাও একই রকম কঠিন। চীনের এ ধরনের কোন উদ্বেগ নেই এবং তারা মূলত অর্থনৈতিক/প্রশাসনিক রাষ্ট্র চালাতে পারবে যেখানে ভারত মূলত একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্র।
শরণার্থী ইস্যুতে সংশ্লিষ্টতা
এই সংগ্রামে চীন মিয়ানমারকে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর অনুমোদন দিয়েছে এবং ভারতও সেটা করেছে, কিন্তু চীন সেখানে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, ভারত যেটা করেনি। ভারতও সেখানে গভীর প্রভাব রাখতে চায়, কিন্তু সে শক্তি তাদের নেই। চীন মিয়ানমারসহ এ অঞ্চলের উপর তার বাহ্যিক প্রভাব বাড়াতে চায়, ভারতও কঠিন চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না।
এই জায়গাটাতে বাংলাদেশও গুরুত্বপূর্ণ কারণ চীন চায় বাংলাদেশ তাদের অর্থনৈতিক ইনিশিয়েটিভের অংশ হোক। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। একটি কারণ হলো একটি উচ্চবিত্ত শ্রেণী রয়েছে এখানে যারা আরও বহু দেশের উচ্চ শ্রেণীর তুলনায় অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশ শুধু চীনা বিনিয়োগ থেকেই উপকৃত হচ্ছে না, বরং চীনের সম্ভাব্য শিল্প-কারখানার জায়গা হয়ে উঠছে যাতে মার্কিন অবরোধ এড়ানো যায়, এ অবস্থায় চীন রোহিঙ্গা ইস্যুকে ছোট করে দেখবেই।
এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা দক্ষিণ এশিয়ার ফিলিস্তিন ধরনের শরণার্থী হয়ে উঠবে যাদের কোন আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকবে না যেহেতু মিয়ানমারের সেই ইসরাইলি যোগাযোগ নেই। তাই কানাডা এবং ইইউ যে ধরনের বহুপাক্ষিক অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে, তার কোন ভবিষ্যৎ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
সে অবস্থায় রোহিঙ্গাদের কি আর করার থাকবে, যদি আদৌ কিছু থাকে, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই মুহূর্তে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বিশ্বের কাছে এই সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছেন, যেটা শুনতে বিশ্ব খুব একটা আগ্রহী নয়।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর