কক্সবাজারে এক পরিবারে পাঁচ প্রতিবন্ধীর অসহায় জীবন
ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার:
ছমুদা বেগম, বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। বাড়ি কক্সবাজার জেলার উখিয়ার রত্ন গ্রামে । স্বামী বাদশা মিয়া মারা গেছেন সেই ৩৫ বছর আগে। স্বামীর রেখে যাওয়া দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে আকঁড়ে আছেন প্রয়াত স্বামীর ভিটে বাড়ি। তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে আত্বীয় স্বাজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের সহায়তায় বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে মেয়েরা তাদের সন্তান সন্তুতি নিয়ে সুখেই আছে।
তবে ব্যতিক্রম তার মেঝ ছেলে জামাল উদ্দিন। বয়স ৪০ এর সীমানায়। ছোট ছোট পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে খেয়ে না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় জীবন কাটছে তার।
জামালের পাঁচ ছেলে মেয়েই প্রতিবন্ধী। তাদের মধ্যে কেও শারিরীকভাবে আবার কেও পায়নি কথা বলার শক্তি। দৃ্ষ্টি প্রতিবন্ধীও রয়েছ তার এই কষ্টের সংসারে।
নাতি নাতনীদের কষ্টে আজ ভালো নেই কক্সবাজারের উখিয়ায় পশ্চিমরত্না গ্রামের অবলা বৃদ্ধা ছুমুদা বেগম। জীবন যুদ্ধ করে কোনরকম নি:শ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত বেঁচে থাকা। উখিয়ার রত পালং ইউনিয়নের পশ্চিম রত্ন গ্রামের রেজু খালের পুব পাশে স্বামীর রেখে যাওয়া প্রায় পনের শতক জমির উপর কাঁচা ঘরে এই বৃদ্ধার। ইতোমধ্যে রেজুর খালের ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বসত ভিটার কিছু জমি হারাতে হয়েছে।
ছমুদা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে জানায়, অনেক দিন আগে স্বামী শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে মারা যায়। এ সময় সহায় সম্বল বলতে একটি কাঁচা ঘর, ছেলে মেয়ে গুলো রেখে যান। বড় ছেলে কামাল পার্শ্ববর্তী গ্রামে আলাদাভাবে সংসার নিয়ে কোন রকমে আছে। মেয়েগুলো শশুর বাড়ীতে নিজ নিজ সংসার নিয়ে মোটামুটি ভাল আছে।
তিনি জানান, মেঝছেলে জামাল আমাদের সংসারেই থাকত। ও সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল, হাট-বাজারে টুকটাক ব্যবসা করে সংসার চালাতো, প্রায় ১৬ বছর আগে জামালকে বিয়ে করাই। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় জামালের চোখে সমস্যা দেখা দেয়। আস্তে আস্তে চোখে কম দেখতে শুরু করে সে। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসকরা তার ডান চোখ অপারেশন করে তুলে নেয়। এরপর কিছু দিন ঝাঁপসা দেখলেও পরে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। এরপর পর আস্তে আস্তে জামালের সম্পূর্ণভাবে সুস্থ পাঁচ ছেলে মেয়ে অন্ধ হয়ে পড়ে। সামর্থের অভাবে কারও চিকিৎসা করতে পারছেনা সে।
জামালের পাঁচ বছরের ছোট ছেলে সাইমন জন্মের পর থেকে দৃষ্টি, বাক ও শারিরীক প্রতিবন্ধি। জামালে বড় ছেলে মোঃ আরমান(১৫), একমাত্র মেয়ে জেসমিন(১৩) গত বছর দৃষ্টি শক্তির হ্রাস পাওয়ার কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। জিহাদুল ইসলাম(১১) এখন একটু একটু দেখে এবং সে স্থানীয় আনন্দ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। কয়েক বছর আগে স্বামী ও ছেলে মেয়েদের এ অবস্থায় ফেলে পুত্রবধু অন্য পুরুষকে বিয়ে করে চলে যায়।
ছমুদা আরো জানায়, সরকার প্রদত্ত বয়স্ক ভাতা ও অন্ধ ছেলে জামাল সমাজ সেবা কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত প্রতিবন্ধি ভাতার উপর নির্ভরশীল হয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন। ঘরের চালা মেরামত করতে না পারায় চালার উপর নারিকেল ও সুপারির পাতা দিয়েছি প্রতিবেশীদের সহযোগিতায়। তবে বৃষ্টি হলে ঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধি জামাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায়, জানিনা আমার কেন এমন হল। কীভাবে ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাঁচব জানি না। হয়ত যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারলে ছেলে মেয়ে গুলো ভাল হতো হয়তো। কিন্তু সেই সামর্থ আমার নেই।
জামালের বড় ছেলে মোঃ আরমান ও মেয়ে জেসমিন জানায়, আমরা সকলে ভাল ছিলাম। কিন্তু কেন এমন হল জানিনা। কয়েক বছরের মধ্যে আমরা সকলে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলি। এখনো কিছু কিছু কাছ থেকে দেখতে পাই। দৃষ্টি শক্তির কারনে আরমান গত বছর স্থানীয় পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণী এবং জেসমিন পশ্চিম রত্ন পালং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই বছর পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনি পরীক্ষা না দিয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
আরমান ও জেসমিন জানায়, তাদেরও অন্য দশজন শিক্ষার্থীর মত হৈ-হুল্লোড় করে স্কুলে লেখা পড়া করে ঘরে ফিরে জীবন কাটাতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় বিনা চিকিৎসায় বৃদ্ধা দাদির উপর ভর করে ধুঁকে ধুঁকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে। বৃদ্ধা দাদিরও চোখের সমস্যা তার উপর নানা রোগে সেও কাতর।
মেঝ ছেলে ১১ বছরের জিহাদুল ইসলাম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলতে থাকে জানিনা আমরা কী করে বাঁচব। আমরা সুস্থ হয়ে বাঁচতে চাই। সু-চিকিৎসা ও সক্ষমতার অভাবে আমরা ৫ সদস্যের একটি পরিবারের হয়তো শেষ ঠিকানা হবে বসতভিটা সংলগ্ন রাক্ষুসী রেজু খাল।
রত্ন পালং ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল কবির চৌধুরী বলেন, এ ধরনের অসহায় একটি পরিবার আমার ইউনিয়নে রয়েছে সে ব্যাপারে কেউ কোন সময় বলেনি। আমি অবশ্যই এই পরিবারের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করবো।