লক্ষীছড়ির আতঙ্কের নাম ‘সুরুজ বাহিনী’: কাঠ পাচারকারীদের তাণ্ডবে অসহায় স্থানীয় প্রশাসন
খাগড়াছড়ি জেলার দুর্গম জনপদ লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার এক আতঙ্কের নাম সুরুজ বাহিনী। গরুর গোয়াল থেকে গরু ছিনিয়ে জবেহ করে ভক্ষণ সহ এমন কোন অপকর্ম নেই এ বাহিনীর সদস্যরা করছেনা! প্রভাবশালী এ বাহিনীর নেতৃত্বে উজাড় হচ্ছে রিজার্ভ ফরেস্ট সহ ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ি-বাঙালির সৃজিত বাগান-বাগিচা। এ বাহিনীর তাণ্ডবে পুরো উপজেলাবাসী আতঙ্কে দিন কাটালেও রহস্যজনক কারণে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। এ সুরুজ বাহিনীর তাণ্ডবে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বাগান মালিকরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এ বাহিনীর রাক্ষুসী তাণ্ডবে সরকারি রিজার্ভ ফরেস্ট, স্থানীয় বাঙালীদের গড়ে ওঠা বনজ বাগান উজাড় শেষে এখন স্থানীয় পাহাড়ীদের বাগান উজাড় শুরু হওয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এ বাহিনী পুরো উপজেলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের উপর চালাচ্ছে সাঁড়াশী তাণ্ডব। এ তাণ্ডবে বাদ পড়ে নি উপজেলার লক্ষ্মীছড়ি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড ডিপি পাড়ার স্থানীয় উপজাতি তারানা মোহন চাকমা, সুবল চাকমা ও বিরেন্দ্র চাকমা, লাইলী বেগম সহ দৈনিক জনকণ্ঠের রাঙামাটি প্রতিনিধি সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী গংয়ের ২০ একর জায়গার উপর ২৫ বছরের পুরনো প্রায় সৃজিত কর্তনযোগ্য প্রায় ১০ হাজার সেগুন, গর্জন সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
ভয়ে আতঙ্কিত বাগানের এসব ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেন, টানা হরতাল ও অবরোধের সুযোগে হঠাৎ গত ৩ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) এ বাহিনীর প্রধান মহিষকাটা এলাকার সুরুজ মিয়া, মোঃ সফিকুল ইসলাম, ফটিকছড়ি দ:পাইন্দং এলাকার মোঃ জাহেদ ইসলাম চৌধুরী, মোঃ আমির আজম সহ এলাকার মোশারফ, জাকির সহ অজ্ঞাত ১০/১৫জনের একটি সন্ত্রাসী দল দেশীয় অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাগানের প্রায় ১০ হাজার সেগুন ও বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় সব গাছ কেটে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, বাগানের মধ্যে রাস্তা তৈরি করে জীপ গাড়ি দিয়ে টানা ৯দিন ধরে গাছ পরিবহণ করে নিয়ে যায় এবং গাছ ও গাছের লাকড়ী গুলো নিকটস্থ ফটিকছড়ির একটি ব্রিকফিল্ডে বিক্রি করে। এতে বাদ পড়ে নি ফটিকছড়ি কাঞ্চন নগরের সীমানার রিজার্ভ ফরেস্টের গাছও। ভয়ে ও সুরুজ বাহিনীর আতঙ্কে কেউ স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করেন নি বলে জানান নি:স্ব হওয়া এসব বাগান মালিকরা।
সাংবাদিক মো. আলী বলেন, কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত প্রজা হিসাবে ১৯৬০ সালে তার পিতা উপজেলা ডিপি পাড়ায় বসতি স্থাপন করেন এবং ২০ একর জায়গার উপর সৃজিত বাগানটি তার অনুপস্থিতিতে সুরুজ বাহিনী কেটে নেওয়ায় তিনি আজ নি:স্ব হয়ে পড়েছেন। সাংবাদিকতা করে কর্মজীবনের একমাত্র অর্জিত বাগানের অর্ধ কোটি টাকার গাছ হারিয়ে তিনি লক্ষ্মীছড়ি থানায় গতকাল (সোমবার) এ বাহিনীর প্রধান সুরুজ মিয়াকে প্রধান আসামী করে লিখিত এজাহার দাখিল করলেও পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করে নি। এছাড়া তিনি প্রতিকার চেয়ে ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধের দাবিতে বিষয়টি লিখিত ভাবে খাগড়াছড়ি জেলার সাংসদ ও লক্ষীছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকেও জানিয়েছেন।
জানা যায়, অভিযোগপত্র পেয়ে জেলার সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য পুলিশ সুপার খাগড়াছড়ির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার শেখ মো: মিজানুর রহমান জানান, বনজ সম্পদ ধ্বংসকারীদের যে কোন মূল্যে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এবিষয়ে লক্ষীছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ রতন কুমার দাশ গুপ্ত জানান, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এদিকে লক্ষ্মীছড়িতে রিজার্ভ ফরেস্টসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন বন ধবংসের বিষয়ে বক্তব্য নিতে গত ৯ ফেব্রুয়ারী দুপুরে লক্ষ্মীছড়ি বন বিভাগ কেন্দ্রে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মীরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। অফিস সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ একমাসেরও বেশি সময় ধরে কার্যালয়ে অনুপস্থিত তিনি। এমনটা নুতনও নয়, প্রতিমাসেই বেতন উত্তোলনের জন্য একবার অফিস আসেন ঐ বন কর্মকর্তা। তবে মামুনুর রশিদ মীরের সাথে সেল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অসুস্থ্য ও ঢাকা আছেন বলে জানান। প্রায় এক ঘণ্টার পর কার্যালয়ে পাওয়া গেল বন প্রহরী মো: শফিকুল ইসলামকে। বন প্রহরী শফিকুল ইসলাম জানান, এ চক্রটি স্থানীয়দের বাগানের পাশাপাশি লক্ষ্মীছড়ি’র প্রায় ৭০ একর সরকারি বাগানের গাছও কেটে সাবার করেছে। তিনি বলেন, আমরা নিজেরাও ঐ চক্রটির ভয়ে তটস্থ। মাত্র তিনজন লোকবল নিয়ে চোরাকারবারীদের প্রতিরোধ করা আমাদের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না। বাধা দিতে গিয়ে কয়েকবার পাচারকারীদের হামলায় পালিয়ে আসতে হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার বন কুমার চাকমা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সুরুজ বাহিনীর প্রধান বরিশাল এলাকার সর্বহারা দলের সদস্য ছিল বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। এ বাহিনী খুবই ভয়ানক। তাদের তাণ্ডবে পুরো উপজেলার বাগান মালিকরা আতঙ্কিত। ইচ্ছা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগেও এ বাহিনী এলাকার জনৈক রুহুল আমিনের গরু ছিনিয়ে নিয়ে জবেহ করে ভক্ষণ করেছেন। কিন্তু কেহ সাহস করে প্রতিবাদ করে নি।
তবে ভিন্ন মতামত প্রদান করে লক্ষীছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শওকত ওসমান বলেন, জায়গাটি ফটিকছড়ি, লক্ষীছড়ি ও মানিকছড়ি উপজেলার ত্রি-সীমানার মধ্যবর্তী স্থানে হওয়ায় এলাকাটি সন্ত্রাসীদের বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে সুযোগ বুঝে এক উপজেলা থেকে অপর উপজেলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।
তিনি জানান, এদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।এরা মূলত পলাতক রয়েছে। তার পরও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি লক্ষীছড়ি জোন কমান্ডারকে জানানো হয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, অচিরেই সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা হবে।