অধিকার আদায়ে আদিবাসীদের আরো বেশী সংগ্রামী হতে হবে- সন্তু লারমা
নিজস্ব প্রতিবেদক:
নিজেদের অধিকার ও দাবি আদায়ে ‘আদিবাসীদের’ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও এখনো এদেশে কোনো গণমুখী সরকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। এ কারণে আমাদের ‘আদিবাসীদের’ অধিকার ও দাবি আদায়ে এখনো আন্দোলন করতে হচ্ছে। দেশে একটি গণমুখী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আদিবাসীদের’ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে বলেও গুরুত্বারোপ করেন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) প্রধান সন্তু লারমা।
৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে দুপুরে রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এসব কথা বলেন। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে জুম্ম (পাহাড়ি) জনগণকে বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে। পাশাপাশি অস্তিত্ব রক্ষায় পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীকে হতে হবে আরো বেশি সংগ্রামী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের উদাহরণ টেনে বলেন, এ সংগ্রামের রূপ কি হবে, সময়ই তা বলে দেবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবার আদিবাসী দিবসের স্লোগান হচ্ছে ‘আদিবাসী অধিকার আদায়ে মুক্তিকামী জনতার সেতুবন্ধন’। অন্যান্যদের মধ্যে এতে উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী ফোরামের সঞ্জিব দ্রং, জনসংহতি সমিতির শক্তিপদ ত্রিপুরা, খাসি ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এন্ড্রু সলেমার, ঐক্য ন্যাপের পংকজ ভট্টাচার্য, আরডিসি’র অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, আইইডি’র নুমান আহমেদ খান প্রমুখ।
এক প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৭ বছর পেরিয়ে ১৮ বছর হতে চলেছে। এ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ১৭ বছরে সরকারগুলো চুক্তি বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, উল্টো চুক্তিপ রিপন্থী কাজ করে চলেছে। এ জন্য চুক্তি বাস্তবায়নে জুম্ম জনগণকে বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে। ‘সংবিধানে আদিবাসীর অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলসহ সারা দেশের ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর অধিকার পর্যুদস্ত করা হয়েছে। পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগুলো প্রতিনিয়ত নিপীড়িত-নিগৃহিত হচ্ছে। অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। অধিকার অর্জন করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ এটি প্রমাণ করেছে আরেকবার।
সন্তু লারমা আরো বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর জাতীয় জীবনে শাসকেরা গণমুখী, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক নয়। তাই নিজেদের অধিকার আদায়ে আরো বেশি সংগ্রামী হতে হবে। সে সংগ্রামে রূপরেখা কি হবে, তা আমি বলতে পারবো না। সময়েই তা বলে দেবে। ‘আদিবাসীদের’ লড়াই- সংগ্রামের বাস্তবতা শাসকগোষ্ঠীকে গভীরে গিয়ে বুঝতে হবে। এটি হালকাভাবে বুঝলে চলবে না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪৩ বছর ধরে সেনাশাসন চলছে। বাংলাদেশের কোথাও তো সামরিক শাসন নেই। এই বাস্তবতা কি নীতি নির্ধারকরা বোঝেন না? অবশ্যই তারা তা বোঝেন। অথচ কিছুদিন আগে একজন মন্ত্রী পূর্বাঞ্চল সফর করে বলেছেন, চুক্তি বাস্তবায়নে আরো নাকি তিন-চার বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ চুক্তি বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্যদিকে, সমতলে অব্যহতভাবে ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী জমি-জমা হারাচ্ছেন, ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন, দেশান্তরী হতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা হতেই পারে। এটি বাস্তবতা।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামক পাহাড়িদের একটি সশস্ত্র গ্রুপ শান্তিচুক্তিবিরোধী সরকারের একাংশ ও সেনাবাহিনীর মদদে সৃষ্টি। শান্তিচুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে এটি সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতি নামক গ্রুপটির সৃষ্টি এক-এগারোর সরকারের মদদে। এটি একটি উপদলীয় চক্রান্ত।
এতে লিখিত বক্তব্যে সন্তু লারমা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ‘আদিবাসীদের’ সাংবিধানিক স্বীকৃতির পাশাপাশি সংসদের উত্থাপিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ বিল-২০১৪ প্রত্যাহার এবং সদ্য পাশ হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪ বাতিল ও বিলুপ্তির দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে সঞ্জিব দ্রং বলেন, সরকার ‘হাত ধোয়া দিবস’সহ আরো নানা দিবস পালন করে। এসব দিবস পালনে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। অথচ ক্ষুদ্র জাতির অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষর করেও সরকার দেশে আদিবাসী দিবস পালন করছে না।
পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, সোমবারই চাঁপাইনবাবগঞ্জে জমির অধিকার রক্ষায় সোচ্চার একজন উঁরাও জনগোষ্ঠীর নেত্রীকে সন্ত্রাসীরা গণধর্ষণ করা হয়েছে। এর আগে রাষ্ট্রীয় বাহিনী অপহরণ করেছে পাহাড়ি নেত্রী কল্পনা চাকমাকে। পাহাড় ও সমতলে ক্ষুদ্র জাতির নারীর প্রতি এমনই সহিংসতা চলছে।
অধ্যাপক মেসবাহ কামাল প্রশ্ন রেখে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রেখে শান্তিচুক্তির পর ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন সাড়ে ৬৫ হাজার পাহাড়ি শরণার্থী। এ ছাড়া পাহাড়ে রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। তাদের অধিকাংশই নিজ বসতভিটা ফেরত পাননি। প্রধানমন্ত্রী কি এদের কথা ভেবে একবার পেছনের দিকে তাকাবেন?
আদিবাসী দিবসের কর্মসূচি :
সংবাদ সম্মেলনে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, ৯ আগস্ট সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পালিত হবে আদিবাসী দিবসের মূল অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান কর্মসূচির উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। সভাপতিত্ব করবেন পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। একই দিন দুপুর ১২টায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দুপুর ১২টায় বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হবে ক্ষুদ্র জাতির মেলা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ ছাড়া ৬ আগস্ট সকাল ১১টায় রাজধানীর শাহবাগে আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে মানববন্ধন। ৮ আগস্ট বিকাল ৩টায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। ১৩টি সংগঠন এর আয়োজক। একই দিন সন্ধ্যা ৬টায় গারো ছাত্র সংসদের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজন করা হয়েছে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি। ১১ আগস্ট বিকাল ৩টায় জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনাসভা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী। কাপেং ফাউন্ডেশন ও আদিবাসী সাংস্কৃতিক ফোরাম এর উদ্যোক্তা। ১৪ আগস্ট বিকাল ৫টায় মাদল গানের দলের উদ্যোগে রাজধানীর আগারগাঁর জাতীয় গ্রন্থাগারে পরিবেশিত হবে ঐতিহ্যবাহী সংগীত।
ঢাকার বাইরে ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে রাজশাহী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট ও নওগাঁয়, আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে, আদিবাসী দিবস উদযাপন কমিটির উদ্যোগে সিলেটে, কুবরাজ অন্তপুঞ্জি উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে মৌলভীবাজার ও কুয়াকাটায়, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদসহ ১৪টি সংগঠনের উদ্যোগে টাঙ্গাইল ও মধুপুরে, আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে নাটোরে, আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে নেত্রকোনা, শেরপুর ও গাজীপুরে পালিত হবে অনুরূপ নানা কর্মসূচি।
আদিবাসী ফোরামের নেতারা বাংলাদেশে বিশ্ব আদিবাসী দিবস জাতীয়ভাবে পালনের আহ্বান জানিয়ে এদেশে আদিবাসীদের ভূমি ও সামাজিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, আদিবাসীরা এখনো নানা দাবিতে তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছে। তাহলে সরকার কীভাবে দাবি করে যে, তারা সকলের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে?
বিশ্বের ৯০টি দেশের ৪০ কোটি আদিবাসীর মতো এদেশেও ৩০ লাখ আদিবাসী বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করবে জানিয়ে পাঁচ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। – See more at: http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/312315.html#sthash.jXZ5mD9s.dpuf