কক্সবাজারে অবশেষে উচ্ছেদ অবৈধ ৫২ স্থাপনা : সংঘর্ষে আহত ১০, আটক ৮
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে ব্যবসায়ীদের মালামাল সরাতে সময় দিয়েও ‘শান্তিপূর্ণ’ উচ্ছেদ করতে পারেনি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
সময় দেয়ার পর দুইদিন পর (১৭ অক্টোবর) শনিবার দুপুরের পর উচ্ছেদ অভিযানে গেলে অবৈধ দখলদার ব্যবসায়ীদের আনা ‘ভাড়াটে’ লোকদের বাধার মুখে পড়তে হয়। এক সময় সেই বাধাই সংঘর্ষে রূপ নেয়। একদিকে ব্যবসায়িদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, অন্যদিকে পুলিশের টিয়ারশেল। সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট হয়ে পড়ে ‘রণক্ষেত্র’। ভাঙচুর করা হয় বুলডোজার, ম্যাজিস্ট্রেট এর গাড়ি। অবৈধ দখলদার ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের পর উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে কউক ও জেলা প্রশাসন। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব আবু জাফর রাশেদ ও কক্সবাজার সদর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. শাহরিয়ার মোক্তার। ওই সময় পুলিশ সদস্যদের নিয়ে উপস্থিত ছিলেন-অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) সার্কেল পংকজ বড়ুয়া, সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনির উল গীয়াস। সংঘর্ষ চলাকালে তিনজন সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
৫২ জন অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করতে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা মতেই উচ্ছেদ
অভিযানে গিয়েছিল কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযানে যাওয়ার আগেই দখলদার ব্যবসায়ীরা টাকা দিয়ে ভাড়া করে কিছু মহিলাসহ শতাধিক মানুষ জড়ো করে রাখেন। দখলদারদের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েকজন নেতা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন। এরপর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে দখলকারীদের ইটপাটকেল গুলির কারণে পুলিশ পিছু হটে। এরপর অতিরিক্ত পুলিশ আসলে দখলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অবৈধ দখলদারদের ভাড়াটে লোকদের রাস্তায় সাদা কাপড় গায়ে দিয়ে শুয়ে রাখা হয়। ওই সময় দখলদারদের নেতারা উস্কানিমূলক বক্তব্য চালিয়ে যান। প্রশাসন উচ্ছেদ করতে চাইলে দখলদার ও ‘ভাড়াটে’ লোকজন হামলা চালায়। ওই সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ এই সংঘর্ষ চলে। পরে কউক ও জেলা প্রশাসন উচ্ছেদে নামে।
এরপর কক্সবাজার পৌর সভার মেয়র মুজিবুর রহমান এসে দখলকারীদের সাথে কথা বলেন। তিনি তাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন। তারপর কউকের আরেকটি বুলডোজার এনে পুরো স্থাপনা উচ্ছেদ করেন।
সুত্রমতে, যমুনা টেলিভিশনের কক্সবাজার প্রতিনিধি নুরুল করিম রাসেল, চ্যানেল এস এর কক্সবাজার প্রতিনিধি স.ম ইকবাল বাহার চৌধুরী ও জিটিভির ক্যামরাপার্সন সাঈদুল ইসলামসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়। ওই সময় পুলিশ অন্তত ৮ জনকে আটক করেছে। তাদের মধ্যে যাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে তারা হলেন, জেলা যুবদল নেতা আমিনুল ইসলাম মুকুল, জয়নাল, সরওয়ার, কাজল। বাকীদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) সচিব আবু জাফর রাশেদ সাংবাদিকদের জানান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কউক ও জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। ওই সময় বাধা দেয়ায় ও হামলা করায় পুলিশ আইন প্রয়োগ করেছে।
তিনি জানান, গত ১৫ অক্টোবর উচ্ছেদ অভিযানে গেলে দখলদার ব্যবসায়িরা মালামাল সরিয়ে নেয়ার জন্য একদিন সময় চেয়েছিলেন। মানবিক বিবেচনায় তাদের একদিন সময় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুইদিন পর আবার উচ্ছেদ অভিযানে গেলে উচ্ছেদ টিমের উপর হামলা চালিয়েছে তারা।
উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের নির্দেশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে ৫২ জন দখলদারের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে গত ১৫ অক্টোবরও বাধার মুখে পড়েছিল কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
ওইদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকাল দুইটা পর্যন্ত প্রশাসন বুলডোজার দিয়ে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের চেষ্টা
করেও বাধার মুখে উচ্ছেদ করতে পারেনি। পরে অভিযান পরিচালনাকারী টিম অর্ধশতাধিক অবৈধ স্থাপনার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও একপর্যায়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করেই ফিরে আসতে হয়েছিল প্রশাসনকে।
ওইদিন দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযানে গেলে কক্সবাজার জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মুকুলের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ জন ভাড়াটে লোক অভিযানে বাধা দেয়ার চেষ্টা চালায়। পাশাপাশি নানা অজুহাতে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করতে করতেও চেষ্টা চালান এই যুবদল নেতা।
জানা গেছে, আমিনের পাশাপাশি উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে নানা অপকৌশল অবলম্বন করেছিলেন ৫২ জনের সিন্ডিকেটের অন্যতম দখলদার ও রিটকারী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও আবদুর রহমান।
বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছিলেন কক্সবাজার সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মোক্তার। তিনি ওইদিন বলেছিলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে সুগন্ধা পয়েন্টে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিই আমরা। উচ্ছেদে এসে দোকানদারদের ঘন্টাখানেক সময়ও দেয়া হয়, যাতে তারা নিজেদের মূল্যবান মালামাল সরিয়ে নিতে পারে। পাশাপাশি এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংও করা হয় মালামাল সরিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু অবৈধ দখলদাররা তা না করে উল্টো বাধা দেয়ার জন্য পরিকল্পনা নেয়। পরে প্রশাসন হার্ডলাইনে গেলে তাদের অনুরোধের কারণে মালামাল সরিয়ে নেয়ার জন্য একদিনের সময় দেয়া হয়েছে।’
এর আগে ১ অক্টোবর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলীর সুগন্ধা পয়েন্টে ৫২ জনের সিন্ডিকেটের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের দেওয়া রুল ও স্থগিতাদেশ খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। ভূমি মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন। ফলে ওই ৫২ ব্যক্তির স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো বাধা নেই বলে জানায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী সুগন্ধা পয়েন্টে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে। পরে কক্সবাজার পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স নেয় দখলদাররা। এই অবৈধ দখলবাজদের কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল উচ্ছেদের নোটিশ দেয়। পরে জসিম উদ্দিনসহ ৫২ জনের সিন্ডিকেটের দখলদাররা একটি রিট আবেদন দায়ের করেন। একই বছরের ১৬ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল জারি করে স্থগিতাদেশ দেন। পরে স্থগিত আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। গত ১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ শুনানি শেষে হাইকোর্টের রুল ও স্থগিতাদেশ খারিজ করে উচ্ছেদের রায় দেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় অনলাইনসহ নানা সংবাদমাধ্যমে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ‘উত্তরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, দক্ষিণে যুবদল কক্সবাজার সৈকতে দখলবাজি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই সব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ‘কলাতলীর সুগন্ধা পয়েন্টের রাস্তার উত্তর পাশে রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ে দখল করে বসানো সারিবদ্ধ দোকান। এখানে রয়েছে শুঁটকি, রেস্টুরেন্ট, ফিশ ফ্রাইয়ের দোকান, ওষুধ ফার্মেসি, ট্যুরিজম অফিসসহ নানা ধরণের দোকান।
এই উত্তর পাশের অবৈধ স্থাপনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। যারা সুগন্ধা বিচের বৃহত্তর
শুটকি, রেস্টুরেন্ট, ফিস ফ্রাই ব্যবসায়ীদের নিয়ে সম্প্রতি একটি সমিতির জন্ম দিয়েছেন রীতিমতো।
এই সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন কক্সবাজার শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবদুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক জসিম উদ্দিন। মূলত এই দুজনের নেতৃত্বে সুগন্ধা পয়েন্টের উত্তর সারির সরকারি শত কোটি টাকার জমি দখলে রয়েছে। তাদের সাথে যারা দখলবাজদের তালিকায় রয়েছে মহেশখালীর মুফিজ, কলাতলীর নুর
মোহাম্মদ, রবিন, তার বড় ভাই নাছির, রাসেল, মো. হানিফ, আরিফ, বাবু, পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস সহকারী আলম, সোহেল, সৈকত, আল্লার দান হোটেলের মালিক মনির, নয়ন, কিবরিয়া, ইয়াহিয়া, ভারুয়াখালীর খালেক, মো: মেহেদী, হালিম, হামিদ সওদাগর, ছোট হামিদ, সাদেক, আবদুল্লাহ বিদ্যুৎ ও সাহেদ।
সুগন্ধা বিচের উত্তর পাশের পাশাপাশি দক্ষিণ পাশেও দখলকা- শুরু হয়েছে সম্প্রতি। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে শহর যুবদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. জয়নাল আবেদীন, নাজিম উদ্দিন নাজু, আচার ব্যবসায়ী নাছির, কলাতলীর আবদুল্লাহ আল মামুন মিঠুসহ আরো কয়েকজন।’
এদিকে সরকারি কাজে বাঁধা প্রদান এবং হামলা ঘটনায় মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পংকজ বড়ুয়া। তিনি জানান, এর মধ্যে আট জনকে আটক করেছে পুলিশ।