কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পের ক্ষতিপূরণঃ ব্যক্তি স্বার্থের রাজনীতির শিকার নিরীহ পাহাড়ি
মাহের ইসলাম:
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা নিয়ে যেকোনো আলোচনার শুরুতেই দেশের সুশীল সমাজ. বিদগ্ধজন, এমনকি অনেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষককে বলতে শোনা যায়, পাকিস্তান আমলে সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি করে বিপুল পরিমাণ পাহাড়ীদের পানিতে ডুবিয়ে বাস্তচ্যুত করায় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম অসন্তোষ দানা বাঁধে, তারা ক্ষুদ্ধ হয়, বিদ্রোহী হয়। তাদের এ বক্তব্যের সারবত্ত্বা কতটুকু তা বিবেচনার দাবী রাখে।
কর্ণফুলী নদীকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা এবং এর ‘অববাহিকার নিম্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণহীন সর্বনাশা বন্যা নিয়ন্ত্রণের’ কথা মাথায় রেখে ১৯০৬-০৭ সালে সর্বপ্রথম এবং ১৯২২ সালে পুনরায় নদীতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৪০ সালে প্রিলিমিনারি রিপোর্ট এবং ১৯৫২ সালে কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্পের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। ( সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ, প্রকাশ: ১৯৯৩ )। ঐ সময় এই প্রকল্প থেকে নিম্নোক্ত পাঁচটি সুবিধা বিবেচনা করা হয়েছিলঃ
- ক। বিদ্যুৎ উন্নয়ন।
- খ। সেচ ও পানি নিষ্কাশন।
- গ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ।
- ঘ। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি।
- ঙ। বনজ সম্পদ আহরণে সুবিধা।
শ্রী বিরাজ মোহন দেওয়ান কর্তৃক রচিত ও ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ হতে জানা যায় যে, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ‘সুচারুরূপে’ পরিচালনার জন্যে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৫ সাল থেকে তৎকালীন চাকমা সার্কেল চীফ (যিনি চাকমা রাজা নামেও পরিচিত) মেজর ত্রিদিব রায়ের সভাপতিত্বে সরকারী ও বেসরকারী কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এক সাব-কমিটি গঠন করেন। “Sub-Committee উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট এক বিস্তৃত রিপোর্ট প্রদান করেন।
ফলে, কাচলং, রাইংখ্যং, ও ঠেগা রিজার্ভ ফরেস্টের কিয়দংশ এলাকা বন বিভাগ হইতে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য মুক্ত করিয়া দেওয়া হয়। রাজা বাহাদুর ঐ সময় পুনর্বাসন এলাকাদি পরিদর্শন করতঃ উদ্বাস্তুদের উৎসাহ প্রদানে তাহাদের সুখ সুবিধার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়া তাহাদের কষ্ট লাঘব করিয়া দেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় আজ সেইখানে স্থাপিত হইয়াছে এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।” (সূত্র: বিরাজ মোহন দেওয়ান, পৃষ্ঠা-১৫২ দ্রষ্টব্য)।
স্মরণযোগ্য যে, বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত উপরোল্লিখিত বইয়ের পুণঃমুদ্রণের সময় রাজা দেবাশীষ রায় বইটিকে “পুস্তকটি অত্রাঞ্চলের ইতিহাস রচনাবলীর মধ্যে অগ্রজ ভুমিকার দাবীদার।” হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। (সূত্র: বিরাজ মোহন দেওয়ান, ২০০৫, অভিমত দ্রষ্টব্য)। একথা মনে করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, বইটির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া এবং এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করা যে, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে স্বয়ং চাকমা রাজার নেতৃত্বে পুণর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
শুধু তাই নয়, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের যথাযথ পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল, যার ফলে পুণর্বাসিতগণ ঐ সময়েই ‘এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ’ এর দেখা পেয়েছিলেন। আরো স্মরণযোগ্য যে, কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল ( নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে)। এই সত্য মেনে নিলে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে এত বছর পরে যারা কাপ্তাই বাঁধের দোহাই দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য আসলে কী?
কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয় যে, ২৫৬ বর্গমাইল এলাকার ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি তলিয়ে গেছে, প্রায় এক লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তন্মধ্যে কিছু লোক ক্ষতিপূরণ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। প্রদীপ্ত খীসা তার ‘পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে তার পরিণতিতে ৯৯ হাজার ৯শ’ ৭৭ জন বাস্তু ও জমিহারা হয়ে পড়েন”। (সূত্র: প্রদীপ্ত খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রকাশ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৩৫ দ্রষ্টব্য)।”
পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই লেক ছিল রাঙামাটি মহকুমার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৬১ সালের আদম শুমারী মোতাবেক রাঙামাটি মহকুমার আয়তন ১৬০১ বর্গমাইল, মোট জনসংখ্যা ১,৬২,৪৯৫ জন এবং মোট বাড়ি ছিল ২৮,৩৭২ টি।
শুমারীর তথ্যানুসারে, রাঙামাটি মহকুমায় প্রতি বর্গ মাইলে বাস করত ১০২ জন লোক। থানা অনুযায়ী, জনসংখ্যার বিন্যাস ছিল নিম্নরূপঃ
যদি ধরে নেয়া হয় যে, কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা এক লাখ; তাহলে উপরের তথ্য অনুসারে, রাঙামাটি মহকুমার মাত্র ৬.২৫% এলাকায় সমগ্র মহকুমার ৬১.৫৪% বাড়ি ও মানুষ ছিল। (মোট আয়তন ১৬০১ বর্গমাইলের মধ্যে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ২৫৬ বর্গমাইল; মোট জনসংখ্যা ১,৬২,৪৯৫ জন, ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ)। পুরো মহকুমার শুধুমাত্র এই ২৫৬ বর্গমাইলে জনসংখ্যার বসতি ছিল, প্রতি বর্গমাইলে ৩৯০ জন। যা যৌক্তিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৩ দ্রষ্টব্য)
সঙ্গত কারণেই, আনিসুল হক তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি’ বইয়ে তথ্য পর্যালোচনা করে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে,
- উপজাতীয় বা বিদেশি লেখকদের কোন লেখায়ই উল্লেখ করা হয়নি যে, পাহাড়িদের সমতল এলাকা প্রীতি আছে বা পাহাড়ির বিরাট সংখ্যক লোক একটা নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস কিংবা কৃষির প্রতি আগ্রহী।
- বরং সবাই একটা বিষয়ে একমত যে পাহাড়িরা ‘জুম নির্ভর যাযাবরী জীবনে অভ্যস্ত’।
- বর্তমানে অনেক খালি সমতল জায়গা থাকা সত্ত্বেও, ‘উপজাতীয়রা পাহাড় বা পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করছে’।
- পাহাড়িদের গ্রামে অন্য এলাকার মতই এক সাথে অনেকগুলো পরিবার থাকে। কিন্তু বর্তমানে যে গ্রামের জনসংখ্যা ১৯৬১ সালের তুলনায় পায় ৪ গুণ হয়ে গেছে, সেখানেও ১০০ হতে ১৫০ পরিবারের গ্রাম খুব একটা পাওয়া যাবে না। (সূত্র: প্রাগুক্ত দ্রষ্টব্য) ।
পাঠকের জ্ঞাতার্থে, কাপ্তাই লেক এলাকার ইউনিয়ন অনুযায়ী জনসংখ্যার বিন্যাস নিচে তুলে ধরা হলোঃ
ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার চিত্র দেখেও এটা বোঝা যায় যে, এক লাখ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হলে অনেকগুলো ইউনিয়নকে পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে দিতে হবে। রাঙ্গামাটি জেলার ম্যাপের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, বিষয়টি কতটা অবাস্তব হতে পারে। সুতরাং, শুধুমাত্র ২৫৬ বর্গমাইলে প্রায় এক লাখ লোকের বাস ছিল এমন দাবী করা মোটেও যুক্তি সংগত নয়। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৩ দ্রষ্টব্য)
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের একটা পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ’ বইয়ে। এ বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “প্রকল্পের প্রতিবেদনে বাঁধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যার হিসাব দেওয়া হয়নি। বাঁধ নির্মাণের পর ১২৫ টি মৌজার মোট ১৮ হাজার পরিবারে ১ লক্ষ লোকের কৃষি জমি অথবা বসতবাড়ী ডুবে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাস্তচ্যুত হয়েছিল। এই ১৮ হাজার পরিবারের মধ্যে ১০ হাজার নদী অববাহিকার সমতল এলাকার চাষী এবং বাকী ৮ হাজার পরিবার জুমিয়া” (সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ, প্রকাশ: ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৩০ দ্রষ্টব্য)।
জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার পূর্বোক্ত বই থেকে আরো জানা যায় যে, পাকিস্তান আমলেই একাধিক দফায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল যা ১৯৫৭ সালে শুরু হয়ে ৩০ জুন ১৯৭৫ সালে সমাপ্ত হয়। পুণর্বাসনের সংখ্যা ছিলো নিম্নরূপ:
অর্থাৎ, সর্বমোট ২৫০৪৭ টি পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে পুনর্বাসন করা হয়। এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাঁধের নির্মাণ কাজের সময়েই শুরু হয় এবং পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলেও চলমান ছিল।
উপরের তথ্যাবলী থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য প্রভাব সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথা সময়েই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে স্বয়ং চাকমা রাজার নেতৃত্বে উপযুক্ত কমিটি গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত সংখ্যা না জানা গেলেও শুমারি ও পাহাড়িদের বসবাসের রীতি পর্যালোচনায় এটা ধারণা করা অমুলক নয় যে, অনেকের দাবিকৃত প্রায় এক লাখ হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত ২৫০৪৭টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৬১ সালে রাঙামাটি মহকুমায় মোট বাড়ি ছিল ২৮,৩৭২ টি এবং জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার পুস্তকে ১৮ হাজার পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধুমাত্র আলোচনার জন্যে বিবেচনা করলেও দেখা যায় যে, ১,৬২,৪৯৫ জন ২৮,৩৭২ টি বাড়িতে বসবাস করত। অর্থাৎ, আলোচনার খাতিরে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা এক লাখ ধরে নিলেও (ইতিপূর্বে দেখা গেছে, এক লাখ লোকের ক্ষতি হওয়ার সুযোগ নেই), কাপ্তাই বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা কোন মতেই ১৭,৪৬০ এর বেশী হতে পারে না। এর বাইরেও সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু পরিবার সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল বলে অনেকেই দাবী করে থাকেন।
অনেকেই বলেন যে, বাস্তভিটার ক্ষতিপূরণ না দেয়াও পাহাড়িদের ক্ষোভের একটা কারণ। আসলেই, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জায়গা-জমি ও বাড়ির জন্যে ভিন্ন ছিল, যথাক্রমে একর প্রতি গড়ে ২৫০ টাকা ও ঘরবাড়ির জন্যে গড়ে ৪০০ টাকা। কিন্তু তখনকার দিনে পাহাড়িরা বসতবাড়ির ভিটা বন্দোবস্ত নিত না। তাই তারা বাড়ির ক্ষতিপূরণ পায়নি, শুধুমাত্র বাস্তভিটার আশেপাশের গাছ-গাছালির ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল।
১৯৬১ সালের শুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যার ৮২% ছিল উপজাতি এবং ১৮% অউপজাতি ছিল। যদিও সাধারণত বাঙ্গালিরাই কৃষিকাজের জন্যে সমতল ভুমিতে থাকতে চায় এবং উপজাতীয়রা জুম চাষের জন্যে পাহাড়ে থাকতে পছন্দ করে, তবুও ধরে নিচ্ছি কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মাত্র ১৮% বাঙ্গালীই ছিল। সে হিসেবে, মোট বাড়ি ১৭,৪৬০ এর ৮২% হিসেবে শুধুমাত্র পাহাড়িদের ১৪,৩১৭ টি বাড়ির ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি, কিন্তু ঐ বাস্তভিটার আশেপাশে রোপিত বাঁশ-গাছের ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়েছিল। সহজ কথায়, এক লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলেও (বাস্তবে, এই সংখ্যা অযৌক্তিক), তন্মধ্যে ১৪,৩১৭ জনের শুধুমাত্র বাস্তভিটার (গাছ-গাছালী বাদে) ক্ষতিপূরণ সরকার কর্তৃক দেয়া হয়নি।
আনিসুল হকের হিসেব মতে, “ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা বড় জোর ৫০ হাজার হতে পারে”। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬৩ দ্রষ্টব্য) । এই সংখ্যা মেনে নিলে (যা বেশী যুক্তিসংগত), মোট ৭১৫৯ জনকে শুধুমাত্র বাস্তভিটার (গাছ-গাছালী বাদে) ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।
সুতরাং, ধারণা করা যেতে পারে যে, ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বর্তমানে অনেক বেশী বলা হচ্ছে। এছাড়াও, এই সিদ্ধান্তে আসা মোটেও অযৌক্তিক নয় যে, ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় আশে পাশে বসবাসকারী কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন লোকদেরও ধরা হয়েছিল। এরই পাশাপাশি “নাম, ঠিকানা ও চেহারায় সনাক্তকরণে অসুবিধে, ভীত সন্ত্রস্ত মানসিকতা, ভাষাগত দুর্বোধ্যতা ছাড়াও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সুযোগী মানসিকতা এবং মানবিক সহযোগিতা প্রদান না করায় কিছু লোক সরকারী সাহায্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে, কিছু লোক বার বার সুযোগ-সুবিধে গ্রহণ করতে পারে, এমন কি আত্নসাতের ঘটনাও ঘটতে পারে।” (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬৪ দ্রষ্টব্য)। একই প্রেক্ষাপটে এও অমুলক নয় যে, ক্ষতিপূরণের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা অংশ তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নিজেরা কুক্ষিগত করেছিলেন।
তাছাড়া পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ দেয়া অর্থের একটা বড় অংশ এই কমিটি ব্যবহার করতে না পারায় তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত যায়। কাজেই পুণর্বাসনের ব্যর্থতার দায় সরকারের চেয়ে চাকমা রাজার নেতৃত্বাধীন কমিটির উপর বর্তায়।
সহজ কথায়, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ভয়াবহতা সরকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং ক্ষতিপূরণের ও পুনর্বাসনের যথাযথ পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন যথাসময়য়েই। কিন্তু, নেতৃবৃন্দের ব্যক্তি স্বার্থের শিকার হয়েছে সাধারণ পাহাড়ি মানুষেরা। এখনো ব্যক্তি স্বার্থেই কর্ণফুলী বাঁধ নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই উন্নয়নমুলক কাজের ফলে জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই ভয়ে উন্নয়নমুলক কাজ স্থগিত করার কোন নজির নেই। বরং, বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে উন্নয়নমুলক কাজের পাশাপাশি সব দেশের সরকারই ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণও তেমনি একটি উন্নয়নমুলক পদক্ষেপ। সরকার কর্তৃক যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও যদি ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পায় এবং পুনর্বাসনের সুফল পেতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
তবে, এর দায়ভার যতটা না তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী স্থানীয় নেতৃবৃন্দের যারা এর বাস্তবায়নের সাথে জড়িত ছিলেন। এক্ষেত্রে, তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের দায় সবচেয়ে বেশী। কারণ, তার নেতৃত্বেই ১৯৫৫ সালে পুনর্বাসন কাজ পরিচালনার জন্যে কমিটি করে দেয়া হয়েছিল। কমিটি যে নামমাত্র ছিল না তা বোঝা যায়, যখন কমিটির সুপারিশেই রিজার্ভ ফরেস্ট এর অংশবিশেষ পুনর্বাসনের জন্যে মুক্ত করে দেয়া দেয়া হয়।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি ও এর ফলে পানিতে ডুবে বাস্তচ্যুত চাকমা সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তান সরকারের প্রতি ক্ষুদ্ধ হওয়ার কথা। বিশেষ করে যে চাকমার সার্কেল চিফের রাজমহল পানিতে ডুবে গেলো তার তো পাকিস্তান সরকারের প্রতি প্রবলভাবে ক্ষুদ্ধ ও বিদ্রোহী হওয়ার কথা, যেমনটা হয়েছিল বাঙালীরা। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালীরা ক্ষুদ্ধ ও বিদ্রোহী হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখলাম?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাঙালী জাতি যখন স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন চাকমা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরও একই কারণে বাঙালীদের মতোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হবার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম খুব সামান্য সংখ্যক চাকমা সম্প্রদায়ের লোকই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হয়েছে। উল্টো তাদের অধিকাংশই রাঙামাটিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে রাজাকারে নাম লেখায়। এমনকি নিজের রাজত্বের বিশাল এলাকা ও রাজমহল ডুবিয়ে দেয়া এবং নিজের বিপুল পরিমাণ প্রজাকে বাস্তচ্যুত করায় যে চাকমা সার্কেল চিফের সবচেয়ে বেশী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার কথা, অথচ সেই চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় হলেন দেশের সবচেয়ে কুখ্যাত রাজাকার। যিনি আমৃত্যু পাকিস্তানের আনুগত্য পোষণ করে পাকিস্তানেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
এ থেকে প্রমাণিত হয় চাকমা সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ এবং চাকমা নেতৃত্ব, কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি করে বাস্তচ্যুত করার পরও পাকিস্তান সরকারের প্রতি বিরূপ বা বিক্ষুদ্ধ ছিলেন না। বরং পাকিস্তান প্রেমী ছিলেন। এর কারণ কী হতে পারে? তারা কি পাকিস্তান সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন?
তাই এতবছর পরে যখন পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের একাংশ সাধারণ পাহাড়িদের চোখের সামনে জাজ্বল্যমান কাপ্তাই বাঁধ দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে তখন বুঝতে কষ্ট হয় না, এখানে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অভিপ্রায়ই প্রধান নিয়ায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের মত কিছু নেতৃত্বের ব্যক্তিস্বার্থেই সাধারণ পাহাড়িরা কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার মতলবেই এখনও নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে তারা সোচ্চার – এমনকি সাধারণ পাহাড়ীদের জন্যে দুর্দশার বিনিময়ে হলেও।
♦ লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।
মাহের ইসলামের আরো লেখা পড়ুন:
- পার্বত্য চট্টগ্রামে অপপ্রচার: মুদ্রার অন্য দিক
- মারমা দুই বোন, অপপ্রচার এবং ডিজিটাল যুগের দুর্বলতা
- পাহাড়িদের সরলতা কি গুটিকয়েকজনের ক্রীড়নক: প্রেক্ষিত বিলাইছড়ি ইস্যু
- পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীঃ নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী
- মিথুন চাকমার প্রতি সহানুভুতি কি অবিচার ?
- দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় চেতনা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে অপপ্রচার বন্ধে কোনো ছাড় নয়
- ইমতিয়াজ মাহমুদ- মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান(ভিডিও)
- অপহরণের প্রতিবাদ: মানবিক, বাণিজ্যিক, না রাজনৈতিক?
- রোহিঙ্গা নিধনে ফেসবুকের অপব্যবহার এবং পার্বত্যাঞ্চলে বাঙ্গালী বিদ্বেষী অপপ্রচার
- পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের ব্যক্তি স্বার্থের কাছে জিম্মি সমাজ ও রাষ্ট্র
- ব্যাক্তিগত বিশ্বাস, সংবাদ মাধ্যম ও নৈতিকতার মানদণ্ড
মাননীয়,
মাহের ইসলাম।আপনি কি বলতে চান।পার্বত্যচট্টগ্রামের কাপ্তাই বাঁধের ফলে সে এলাকায় বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীর কোন ক্ষতি হয়নি।শুধু কি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যক্তি সার্থের জন্য অপপ্রচার।
যদি তাই হয়েথাকে তাহলে ভারতের অরুণাচলে যে চাকমা ও হাজং জনগোষ্ঠী এখনও ভারতের নাগরিকত্বের জন্য দাবী চালিয়ে যাচ্ছে,এবং সেখান কার রাজ্য সরকার ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে বিরোধীতা করছে,তারা তাহলে কি কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে সেখানে যায় নি।তারা কি পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্ট্র থেকে সেখানে রিফিউজি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিল।
এর পর তখন কার সময়ে ভারতের মিজোরাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যে কত সংখ্যক উদ্বাস্তু চাকমা পরিবার গোপনে রয়ে গেছে তার কথা বাদও দিলাম।
আর সংখ্যার যে পরিসংখ্যান আপনি উপস্থাপন করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই:- শুধু অরুণাচলের অবস্থানরত বর্তমান চাকমা ও হাজং-দের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান দেখে কাপ্তাই বাঁধের সময়ের সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনা করলে বুঝতে পারবেন,আপনার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী(১৭৪৬০পরিবার)-এর সাথে কোন মিল খুজে পান কি না।
তাই অনুরোধ থাকবে,এরকম কোনরূপ ভুল তথ্য উপস্থাপন করে,মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর মতো জগন্য লেখনি প্রচার করে কোন একটি জনজাতির নৈতিক দাবীকে উপেক্ষা করে মন্তব্য অপপ্রচার করা থেকে বিরত থাকুন।