আবারো রাঙামাটি জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

fec-image

দুর্নীতি

চৌধুরী হারুনুর রশীদ:
যাত্রার শুরুতেই ঘুষ, দলীয়করণ, নিয়োগ বাণিজ্য ও হাট-বাজার ইজারাসহ রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে উঠেছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। সম্প্রতি পরিষদের অধীন বাজার ফান্ড প্রশাসন পরিচালিত জেলায় ৫৭ হাট-বাজার ইজারা নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টির পরপরই এবার বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শূন্য পদে ৯০ সহকারী শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন না হতেই উঠেছে বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির গুঞ্জন।

শোনা যাচ্ছে ৯০ জন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের নামে চলছে প্রহসনের আয়োজন। এতে প্রার্থীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র সংগঠনের লিয়াজো কমিটির নেতা বলেন, আমাদের দাবি প্রাপ্য কোঠামতে যদি নিয়োগ না দেয় তাহলে আমরা সহজে মেনে নেব না।

উল্লেখ্য, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণাধীন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯০ সহকারী শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণে আগ্রহী প্রার্থীদের নিকট আবেদন জমা দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। শুক্রবার প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২৬ মে মঙ্গলবার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অফিস কক্ষে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

৯০ পদে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ২ হাজার ৩১৫ প্রার্থী। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হতেই ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্য, দলীয় ও আত্মীয়করণসহ এ নিয়ে উঠেছে বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ।

প্রাপ্ত অভিযোগে জানা যায়, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও দলীয় নেতাকর্মীদের পূর্ব পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে খুব তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে। এজন্য নিয়োগের নামে চলছে প্রহসনের আয়োজন। যে কারণে শুক্রবার লিখিত পরীক্ষা শেষে এর ফলাফল প্রকাশ করা হয় শনিবার রাতে। মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে মাত্র দুই দিন পর আজ সকালে। এরপর রাতেই দেয়া হবে চূড়ান্ত ফলাফল। অর্থ্যাৎ পুর্ব পরিকল্পিত তালিকামতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার আয়োজন সব শেষ। এখন বাকি শুধু মৌখিক পরীক্ষার লোক দেখানো নাটকের সর্বশেষ দৃশ্য।

স্থানীয়রা জানান, স্ব স্ব উপজেলা বাসিন্দাদের নিয়োগ দেয়ার শর্ত থাকলেও বিভিন্ন উপজেলায় অনেক বহিরাগত প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। বরকলে ২২ শূন্য পদে স্থানীয় শুধু ২জন নিয়োগ পাচ্ছেন। বাকিরা সবাই বহিরাগত বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রার্থীদের অনেকে বলেন, পরীক্ষায় শতভাগ প্রশ্নের সঠিক উত্তর লেখার পরও তাদের রোল নম্বর উত্তীর্ণ তালিকায় স্থান পায়নি। অপরপক্ষে যারা লিখতে না পেরেও অদৃশ্য ইশারায় তাদের নামে পূর্ণ প্রশ্নোত্তর সম্বলিত খাতা জমা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ঘুষ, দলীয় ও আত্মীয়করণের আশ্রয়ে যাদেরকে পূর্বেই বাছাই করা হয়েছে তাদের রোল নম্বর নিশ্চিত করে উত্তীর্ণ তালিকার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে জামায়াত শিবির প্রার্থীর রোল নম্বরও উত্তীর্ণ তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

যে অভিযোগে মেধা ভিত্তিক যাচাইয়ের কারণে এমনটা হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও তা স্বীকার করেছেন জেলা পরিষদ সদস্য মো. জানে আলম। তিনি বলেন, তারা বিদ্যালয়গুলোকে মেধাহীন করতে চান না। তাই দলমতের উর্ধ্বে থাকার কারণে জামায়াত শিবির প্রার্থীকেও উত্তীর্ণ তালিকায় আনা হয়েছে।

এদিকে মেধা তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি পদে ৩ প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে ৯০ পদের বিপরীতে ২৭০ প্রার্থীকে সুযোগ দেয়ার কথা থাকলেও রাখা হয়েছে ২০৮জনকে। এক্ষেত্রে নানা গড়িমসি ও হিসাবের গড়মিল বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করা হয়।

তবে এ ব্যাপারে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনছুর আলী চৌধুরী বলেছেন, প্রত্যেক পদে ৩ প্রার্থীকে রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার হিসাব নিয়ে এমনটি হয়েছে। তিনি নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রশ্নে বলেন, সেসব অভিযোগ নিয়ে তার কিছুই জানা নেই। কিছু হয়ে থাকলেও সেখানে তাদের করার কোনো কিছু নেই। কেননা, এসব নিয়োগে তাদের ভূমিকা শুধু কেরানির মতো।

জেলা পরিষদের শিক্ষা বিষয়ক সভাপতি ও জেলা পরিষদ সদস্য অংসুইপ্রু চৌধুরী এবং অপর সদস্য মো. জানে আলম দাবি করে বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। মেধা অনুসারেই শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হবে।

এদিকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলার ৫৭ হাট-বাজার ইজারা ডাক নিয়ে লংগদু উপজেলার মাইনিমুখ বাজার ইজারায় বিস্তর অভিযোগ তুলে শুক্রবার রাঙামাটি শহরে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সনজিত কুমার দাশ নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দৈনিক বীর চট্রগ্রাম মঞ্চ,পার্বত্যনিউজ, সিএইচটি ক্রাইম নিউজসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।

বিগত ৫ বছর ১০ মাস দলীয় ব্যানারে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ, পোস্টিং বাণিজ্য ও ভূয়া প্রকল্প অধীনে এসব নব্য নেতারা লুটপাট চালিয়েছে। এদের মধ্যে ২/৩ জন সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে টেন্ডারবাজিতে কাজ সম্পন্ন না করে বিল উত্তোলন করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিগত পরিষদের নিয়োগ পরীক্ষার খাতা টেজারীতে জমা রাখার নিয়ম করলেও বর্তমান পরিষদ এসব তোয়াক্কা করে না।

গত ২৫ মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে সরকার ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নতুন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করে। এতে চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও গত পরিষদ সদস্য বৃষকেতু চাকমা। অন্য সদস্যরা হলেন-জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর, লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জানে আলম ও নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ত্রিদিব কান্তি দাশ, জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, বরকল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুবীর কুমার চাকমা, রাঙামাটি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা অমিত চাকমা রাজু, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাধন মণি চাকমা, আগের সদস্য ও কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুইপ্রু চৌধুরী, কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা থোয়াইচিং মারমা, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা স্মৃতি বিকাশ ত্রিপুরা, রাজস্থলী উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা চানমুণি তঞ্চঙ্গ্যা, বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রেমলিয়ানা পাংখোয়া, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের জেবুন্নেছা রহিম ও নিখোঁজ জেলা কৃষক লীগ নেতা অনিল তঞ্চঙ্গ্যার স্ত্রী সান্ত্বনা চাকমা।

শুরুতেই এ পরিষদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যে কোন মুহুর্তে এসব নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে হামলাসহ সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন