আলীকদমের মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধর: মরণেই পূর্ণ হলো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি!

Dananjoy_Alikadam News Pic
মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম (বান্দরবান) প্রতিনিধি:
‘৭১-এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের লড়াকু সৈনিক আলীকদমের মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধর (৮০) মারা গেছেন। মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) সকাল সাড়ে ছয়টায় তিনি আলীকদম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘ রোগভোগের পর পরলোক গমন করেন।

তাঁকে মঙ্গলবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেওয়ার পর আলীকদম কেন্দ্রীয় শ্মশানে দাহ করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৪ ছেলে ও ২ মেয়েসহ অসংখ্যা গুণগ্রাহী রেখে যান।

ধনঞ্জয় ধর জীবদ্দশায় দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত হতে পারেন নি। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপের কমতি ছিল না।

মঙ্গলবার বিকেলে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাহ করার পূর্বে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি পতাকা, চেয়ারে বসে চাকরি করতে পারছি, কথা বলতে পারছি। সে রকম একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, এতে কোন দ্বিধাদ্বন্ধ নেই। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করে ইউএনও বলেন, তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি’।

[২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধর এ প্রতিবেদকের কাছে যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর তাঁর স্মৃতিকথা তুলে ধরেন। সে সময় তাঁকে নিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। সে সময়ে তাঁর অনুস্মৃতি থেকে নেওয়া তথ্যাবলী নিচে তুলে ধরা হলো]

পরলোকগত মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধর ২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এভাবে-
“মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সংসারের মায়া ত্যাগ করে জীবনবাজি রেখে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের সাবরুম-হরিণা ক্যাম্পে চলে যাই। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরত এসে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমার মতো অনেকের ত্যাগে ও কষ্টে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণপণ লড়লেও শেষ বয়সে এসে আমার জীবন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে!

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তুলতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখনো মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি স্বরূপ ‘সনদপত্র’ পাইনি। নানান জনের কাছে গিয়েছি। সকলে আশ্বাস দিয়েছে বটে। কাজ করেনি। আমি দুর্ভাগা; নইলে স্বাধীনতার এতবছর পরও তালিকায় নাম ওঠেনি কেন!

ধনঞ্জয় ধর জানান, “যুদ্ধকালীন সময়ে আমার গ্রামের বাড়ি ছিলো কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার দিগরপানখালী গ্রামে। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু খুন হবার খবর শুনেই পরদিন ১৬ আগস্ট আমি স্বপরিবারে পাহাড়ি এলাকা আলীকদমে চলে আসি।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমার জীবনের নৌকার পালে হাওয়া লাগেনি! আমার এখন পড়ন্ত বেলা। এ বয়সেও যখন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলাম না তখন মরণই একমাত্র গতি!”

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করে ধনঞ্জয় ধর জানান, “চকরিয়ার তেজেন্দে দে, নুর মোহাম্মদ, পুলিন শর্মা ও সন্দিপের শামশু কমান্ডারসহ আমরা ৩২ জনের একদল যুবক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের লোহারবন ১নং সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যাই। ৩০ দিন প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের হরিণা ক্যাম্প থেকে অস্ত্র নিয়ে আমরা ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা রামগড় বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি। রাঙ্গুনিয়া এলাকায় হানাদার বাহিনীর হাতে আমি ধরা পড়েছিলাম। তবে কৌশলে আমি পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। পালিয়ে এসে সাতকানিয়ার পুটিবিলায় যুদ্ধকালীন ক্যাম্পে যোগ দেই। ওই সময় আমরা সাতকানিয়া থানায় হামালা চালিয়ে কিছু গোলাবারুদ সংগ্রহ করি”।

ধনঞ্জয় ধর আরো জানান, “আজিজনগর এলাকা থেকে ১৮ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে ধরে পুটিবিলা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আমরা হত্যা হত্যা করি”।

এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে চকরিয়ার ঘুনিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জেডএ দিদারুল ইসলাম জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনিও সাতকানিয়া থানা আক্রমণে অংশ নেন। এ আক্রমণে সন্দিপের কমান্ডার শামশু বিএসসি, উখিয়ার আইয়ুব বাঙ্গালী এবং ধনঞ্জয় ধরসহ অনেকে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার গ্রুপ কমা-ার ছিলেন সন্দিপের শামশু বিএসসি। এ গ্রুপে মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয়সহ ৪ জন ছিলেন চকরিয়ার বাসিন্দা’।

সরকারি চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধা মোহসিন সর্দারসহ আলাপকালে ধনঞ্জয় ধরকে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেন আপনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে সময় তালিকাভুক্ত হতে পারেন নি?’

উত্তরে ধনঞ্জয় ধরে বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পরই পর্বতময় এলাকা আলীকদমে চলে আসি। আমার পিতা গরীব ছিল। তাই পড়ালেখা করতে পারিনি। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নিতে হবে সে ধারণা আমার ছিল না। স্বাধীনতার পর সরকারের আদেশে অস্ত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু তালিকায় নাম উঠাতে হবে ভাবিনি”।

ধনঞ্জয় ধর আরো জানান, “মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিই। এ সময় মুক্তিযোদ্ধের সর্বাধিনায়ক মুহাম্মদ আতাউল গনী ওসমানী’র নামাঙ্কিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র’ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। আমার সনদপত্র নং- এন-৩০৪৯২।”

ধনঞ্জয় ধর তাঁর সনদটি এ প্রতিবেদককে দেখান। সনদে উল্লেখ আছে, “তিনি ১নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর অবদান চির উজ্জ্বল হয়ে রইবে”।

২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয়, চকরিয়া মুক্তিযোদ্ধা (বর্তমানে প্রয়াত) আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর সাথে। তিনি জানান, “ধনঞ্জয় একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে আমার সহযোদ্ধা হিসেবে ধনঞ্জয় ধর ছিলেন”।

স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ী হলেও জীবনযুদ্ধে পরাজিত ধনঞ্জয় ধরের আক্ষেপের কমতি ছিল না। তিনি জানান, “আমি আনুমানিক ১০ শতক জমিতে ঘর করেছি। তবে এ জমি আমার নামে সরকারি রেকর্ডভুক্ত হয়নি। আমার ২ মেয়ে ৪ ছেলে এবং স্ত্রীকে সংসার। ২ মেয়েকে পাত্রস্থ করেছি। ২ ছেলেও বিয়ে করেছেন। আমার বয়স এখন ৭৬। হাঁপানীসহ বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছি। বর্তমানে আমার কোন আয় নেই। ছোট দু’ছেলের আয়ের ওপর দুঃখ কষ্টে দিন কাটে আমার”।

২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিকেল। মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধরের সাথে আলাপচারিতা শেষ করবো। এ সময় আমি একবাক্যে তার শেষকথা জানতে চাই।

তখন মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধর আক্ষেপের সুরে বললেন, “দাদু, জীবন যুদ্ধে পরাজিত হতে চললেও দেশমাতৃকার যুদ্ধে আমি বিজয়ী বীর। যুদ্ধ করেছি তাই স্বীকৃতি চাই”।

শেষ কথাঃ
ধনঞ্জয় ধর জীবনে হয়তো সরকারি তালিকায় মুক্তিযাদ্ধা হিসেবে তার নাম তুলতে পারেন নি। তবে পুরো আলীকদম উপজেলায় তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিতে দলমত নির্বিশেষে কারো দ্বিমত ছিল না।

“যুদ্ধ করেছি তাই স্বীকৃতি চাই”- তাঁর এ ইচ্ছা মরণেই পূর্ণ হলো।

২৫ আগস্ট, ২০১৫ ইং। বিকাল সাড়ে চারটা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, লামা ও আলীকদমের মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতিতে পুলিশ ও সেনা সদস্যদের দ্বারা তাঁর কফিনে রাষ্ট্রীয় মর্যদা গার্ড অব অনার দেওয়া হলো!

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন