কক্সবাজার শহর ও টেকনাফ সীমান্ত ভেজাল ওষুধে সয়লাব

farmacos1
স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার :

কক্সবাজার শহরের অলিতে গলিতে ও উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে ভেজাল ওষুধে সয়লাব এবং মিয়ানমারে অবাধে পাচার করছে একটি অসাধু চক্র।

 

জেলা থেকে কী শহর, কী প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই রোগী আসল ওষুধের মূল্য দিয়ে নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। আর সাথে সাথে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে সংশ্লিষ্ট মেডিসিন কোম্পানীর কর্মকর্তাদের যোগসাজসে একশ্রেণীর অসাধু পাচারকারীরা মিয়ানমারে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ওষুধ পাচার করছে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভুয়া লাইসেন্সধারী প্রায় কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশই উৎপাদন করা হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা বাজারের ভালো ব্র্যান্ডের ওষুধের মোড়ক, প্যাকেট ও বোতল নকল করে ওষুধ তৈরি করছে। আর এর মাধ্যমে বছরে প্রায় কোটি কোটি টাকার নকল ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। কক্সবাজার শহরের বিশেষজ্ঞমহল জানান, ভেজাল ওষুধের মধ্যে আটা, ময়দা, চিনি, বেসন, নিম্নমানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড (ওষুধের কাঁচামাল) ও পানি মেশানো হচ্ছে।

অন্যদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত তদারকি ও নজরদারির অভাবে গ্রামগঞ্জ, মফস্বলের ফার্মেসিগুলো এখন ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে রাজধানীর সবচেয়ে বড় ওষুধের মার্কেট মিটফোর্ড থেকেই বেশির ভাগ ভেজাল ওষুধ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজার ওষুধ পরীক্ষাগারের তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে প্রায় এক হাজার ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ পাওয়া গেছে অনেক প্রোডাক্টে। আর অনেক কোম্পানীর এমআর ও কোম্পানীর কর্মকর্তারা ভেজাল ওষুধ বিক্রি ও পাচারে জড়িত রয়েছে।

শহরের হাসপাতাল সড়কের বাসিন্দা ওসমান জানান, মানুষ এখন বেশি টাকা দিয়ে মানহীন ওষুধ খাচ্ছে। রোগীরা মুনাফালোভী বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর হাতে জিম্মি। এক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কোন নজরদারী নেই বললেই চলে। এরকম হলে নকল ওষুধ খেতে খেতে মানুষ চিকিৎসা করার পরিবর্তে উল্টো আরো তাড়াতাড়ি মরে যাওয়ার উপক্রম হবে।

খোঁজ আরো জানা যায়, কক্সবাজার জেলা শহরের সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, হাসপাতাল সড়কের বিভিন্ন ফার্মেসীতে ও সদরের ইসলামপুর রামু, উখিয়া সীমান্ত, টেকনাফ এর বিভিন্ন এলাকাসহ রোহিংগা ক্যাম্পের বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যাবে। মাঝে মধ্যে এসব কারখানা থেকে আটক হওয়াদের কারাদণ্ড হলেও ছাড়া পেয়ে পুরনো ব্যবসায় ফিরে যান।

ওষুধ মালিক সমিতির তথ্য মতে, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি মূল্য কম হওয়ায় কিছু অসাধু খুচরা ব্যবসায়ী নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করছেন। তারা ডাক্তারের পরামর্শপত্রে যে ওষুধের নাম লেখা থাকে তা না দিয়ে রোগীকে একই ওষুধ বলে নিম্নমানের ওষুধ গছিয়ে দিচ্ছেন। শহরের ফোকাস গ্রুপের সহ-ডিরেক্টর মোহাম্মদ আবদুল জাব্বার জানান, ভেজাল ও নকল ওষুধ মূলত বিক্রি করছে অনুমোদনহীন কিছু কোম্পানি। এর সঙ্গে যে ওষুধগুলোর বিক্রি বেশি অসাধু ব্যবসায়ীরা সে ওষুধের প্রয়োজনীয় ও নির্দিষ্ট কাঁচামালের পরিবর্তে নিম্নমানের পদার্থ মিশিয়ে আসল ওষুধের প্যাকেট বা নাম দিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করছেন।

এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মুনাফালোভী চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ ধরনের অপকর্ম করছেন। ভেজাল ও নকল ওষুধের মধ্যে বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে এমন ধরনের বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পরিমাণ বেশি। এদিকে নকল ও ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব হওয়ায় রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি আসল ওষুধের দামে নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

নকল ওষুধ বিক্রি হওয়া ইনজেকশনের মধ্যে নকল হচ্ছে হাইড্রোকরটসিন, মিথাইল প্রডেনিসোল গ্রুপের ইনজেকশন। ময়দা দিয়ে নকল হচ্ছে যক্ষ্মায় ব্যবহৃত রিফিমপিসিন ট্যাবলেট। কিডনি ও ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইপরেক্স ইনজেকশনেরও ভেজাল তৈরি হচ্ছে। কক্সবাজার জেলায় প্রায় ১০ হাজার চেয়ে বেশি ওষুধের দোকান থাকলেও রেজিস্টার্ড নাই প্রায় দোকানের। নামমাত্র ২০০ টাকা দিয়ে একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসার দোকান খুলে বসে যাই। সাধারণত নিচুমানের ওষুধের মূল্য ভালো ব্র্যান্ডের ওষুধের মূল্যের প্রায় সমান কিন্তু বাজারে চালানোর জন্য পাইকারি মূল্য কম ধরা হয়। যেমন আসল গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ অমিপ্রাজলের মূল্য ৪০০ টাকার বেশি হলেও নকল অমিপ্রাজলের পাইকারি মূল্য ৭০ টাকার বেশি। ব্যথার ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ১০০ টাকা হলেও নকল ওষুধের দাম ১৭ টাকা।

এ ছাড়া নকল ওষুধের মধ্যে আরও তৈরি হচ্ছে হরমোলিড বায়োজেন, রেনিটিডিন, মাই গ্লোড, সাসটন নামের বিভিন্ন ওষুধ। এসব কারখানায় কোনো দক্ষ ক্যামিস্ট বা ফার্মাসিস্ট দ্বারা ওষুধ তৈরি হয় না।
ভেজাল ওষুধের মধ্যে আটা, ময়দা, চিনি, বেসন, পানি মিশিয়ে ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল তৈরি হয়।
ভেজাল ওষুধে সয়লাব গ্রামগঞ্জ : এদিকে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হয়ে গেছে গ্রামগঞ্জসহ মফস্বলের বাজার। এর মূল কারণ পর্যাপ্ত তদারকি ও নজরদারি নেই। ভেজাল ওষুধ তৈরিকারী সংঘবদ্ধ চক্র এ ভেজাল ওষুধগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থায় প্রয়োজন একটি যুগোপযোগী ওষুধনীতি।

আরো জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোয় বিনামূল্যের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। কক্সবাজারসহ বিভিন্ন উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোর কর্মচারীরা হাসপাতালের ওষুধ ফার্মেসিতে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন এমন অভিযোগ বেশ পুরনো। অনেক সময় মফস্বলের ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ সরকারি ওষুধও বিক্রি হতে দেখা যায়। এ অবস্তা চলতে থাকলে মিয়ানমারে পাচার অব্যাহত সাথে সেদেশ থেকে নকল ও ভেজাল ওষুধের  বদৌলতে আসছে ইয়াবা ট্যাবলেট ও মানুষের রোগব্যাধি আরো বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, পার্বত্যনিউজ, ভেজাল ওষুধ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন