কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও রস

fec-image

কালের পরিক্রমায় আধুনিকতা ও কালের বিবর্তনে কক্সবাজারের চকরিয়া জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুরের গাছ ও রস। ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে জেলার বৃহত্তম উপজেলা হিসেবে বিবেচ্য চকরিয়া উপজেলা। এক সময় গ্রামীণ জনপদের রাস্তার মেঠো পথের দুই পাশেই চোখ বুলালেই দেখা যেত খেজুর গাছের সারি। বর্তমানে এমন দৃশ্য সহজেই দেখা মেলেনা তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রামাঞ্চলে খেজুরের গুড় ও রস ছিল সর্বজন সমাদৃত। শীতের আগমনে গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়তো।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ জনপদে রাস্তার ধারে ও বসতভিটার আঙিনায় অতীতের মতো এখন তেমন একটা খেজুর গাছ দেখা যায় না। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে দিন দিন খেজুরের গাছ কমতে থাকায় গাছিরাও বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। শীতের মৌসুম আসলে খেজুর গাছে গাছে ঝুলানো দেখা যতো মাটির তৈরি রসের হাড়ি। কনকনে শীতে হারিকেন জ্বালিয়ে খেজুর রস চোরের ভয়ে গভীর রাত পর্যন্ত রসের হাড়ি পাহারা দিত। শীতের বিকেলে মাটির তৈরি রসের হাড়ি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করত গাছিরা। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি ও পৌষ মাসের শুরুতে গাছ থেকে গাছি রস নামানো শুরু করে।

বর্তমানে যে সব গ্রামাঞ্চলে যে কযেকটা খেজুর গাছ দেখা গেছে তাতে মাটির তৈরি হাড়ির পরিবর্তে প্লাস্টিকের পানির বোতল ব্যবহার করছে। শীত মৌসুম আসলে যে সব গ্রামে খেজুর গাছ ছিল প্রায় বাড়িতে নতুন ধানের চাউল দিয়ে খেজুরের রসের পায়েশ রান্না দুধ চিতই পিঠা বানানোর ধুম পড়তো। আর গ্রামের মানুষ স্বজনদের নিয়ে অতিআনন্দে পায়েশ ও দুধ চিতই পরিবেশন করতো। এখন তা ফুরিয়ে গেছে।

কোনাখালী ইউনিয়নের পুরিত্যাখালী এলাকার রশিদ আহমদের সাথে কথা হলে জানান, বাড়ির আঙিনাসহ ভিটে বাড়িতে বেশ কিছু খেজুরের গাছ ছিল। ওই খেজুর গাছের রস দিয়ে বাড়িতে নানা ধরণের পিঠা তৈরি করতো। বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগের কারণে এসব খেজুর গাছ ভেঙে গেছে।

ডেমুশিয়া ইউনিয়নের বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেন জানান, শীত মৌসুম এলে গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস বিক্রি করতে নানা বয়সের লোকজন দেখা যেত। এখন আগেকার মতো তেমন খেজুর গাছও নেই রস বিক্রেতাদের দেখা যায়না। বিভিন্ন দুর্যোগ ও দিন দিন বসতি স্থাপনের কারনে ঐতিহ্যের এই খেজুর গাছ বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

তাদের মতো বিভিন্ন গ্রামের মানুষের সাথে কথা হলে তারা জানান, সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে খেজুর গাছ দেশ থেকে বিলীন হবে না। গ্রামীন এই ঐতিহ্য প্রকৃতিক সম্পদ বিলীনের হাত থেকে বাঁচতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসতে হবে। শীত মৌসুমে শীত যতো বাড়তে থাকে খেঁজুর রসের মিষ্টতাও ততো বাড়ে। শীতের সাথে রয়েছে খেঁজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। একসময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সু-মধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হতো পিঠা, পায়েস ও গুড় পাটালী তৈরীর ধুম। গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও বাটালী গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যেতো। খেজুর রসের পায়েস, রসে ভেজা পিঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবাররতো জুড়িই ছিল না।

কিন্তু কালের পরিবর্তনে প্রকৃতি থেকে আজ খেজুরের রস একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীণ বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ আর গুড়ের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিলো।

অনেকে শখের বশে খেজুর গাছকে মধুবৃক্ষ বলে থাকতেন। শীতের মৌসুমে খেজুর রসের নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো গ্রামীন জনপদ। শখের বসত প্রাকৃতিক ভাবে জন্মানো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছিদের মতে, আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই। ফলে শীতকাল আসলেই অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামীণ জনপদের খেজুর গাছের কদর বেড়ে যায়। বর্তমানে এসব অঞ্চলে প্রতি হাড়ি খেজুর রস এক থেকে দেড়’শ টাকা বিক্রি করা হয়।

বর্তমানে চাহিদার তুলনায় খুবই কম। খেজুর গাছ রক্ষায় বন বিভাগ ও প্রশাসনের কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না থাকায় ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ আর শীতের মৌসুমে খেজুর গাছের রস শুধু গল্পে পরিনত হতে চলেছে।

স্থানীয়রা জানান, ঐতিহ্যবাহী এ খেঁজুর রসের উৎপাদন বাড়াতে হলে টিকিয়ে রাখতে হবে খেজুর গাছের অস্তিত্ব। আর সে জন্য যথাযথ ভাবে পরিবেশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যেকোন বৃক্ষ নিধনকারীদের হাত থেকে খেঁজুর গাছ রক্ষা করতে হবে।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হেসেন বলেন, গ্রামীণ জনপদের যে সব রাস্তা রয়েছে এতে কিছু কিছু এলাকায় কৃষকদের খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পার্শের পরিত্যক্ত স্থানে কৃষকেরা পর্যাপ্ত পরিমান খেজুর গাছ রোপন করলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এবং প্রাচীন ঐতিহ্য এ খেঁজুর গাছের মাঝে অতীতের অস্তিত্বও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন