দীর্ঘ অপেক্ষার পর মেসির হাতে বিশ্বকাপ

fec-image

দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হলো বিশ্ব সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির। গতকাল কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচটি। শত বাধা পেরিয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স মুখোমুখি হয়।

বিশ্বকাপের এরকম ফাইনাল এর আগে কখনো হয়েছে কি না সন্দেহ। একটা দল তিনবার গোল করে এগিয়ে যায়, প্রতিপক্ষ দল প্রতিবারই সমতায় ফিরে আসে। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকার নামের ভাগ্যপরীক্ষায়।

গোল উৎসব, একপেশে থেকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, রোমাঞ্চকর ১২০ মিনিট, বারবার বাঁক-বদল, রুদ্ধশ্বাস শিরোপা লড়াইয়ে শেষটায় স্নায়ুক্ষয়ী টাইব্রেকার! যেখানে শতভাগ সফল হয়ে শিরোপা উল্লাসে মেতে উঠল লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির হাতে উঠল আরাধ্য সেই সোনালী ট্রফি।

খেলা যখন ৭৯ মিনিট মাঠে গড়িয়েছে তখন দুই গোলে এগিয়ে শিরোপার সুবাস পাচ্ছিল আর্জেন্টিনা। এরপরই অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা; এতক্ষণ দ্বিতীয় সেরা দল হয়ে থাকা ফ্রান্সের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন। দুই মিনিটের ঝড়ে মোড় ঘুরিয়ে দিলেন কিলিয়ান এমবাপে।

অতিরিক্ত সময়ে লিওনেল মেসির সহজ-সুন্দর এক গোল। তবে অন্যপাশে এমবাপে তো হার মানার পাত্র নন। তার পায়ে আবারও নতুন মোড়। এবং টাইব্রেকারের রোমাঞ্চ। সেখানে আরও একবার নায়কের বেশে হাজির এমিলিয়ানো মার্তিনেস। ৩৬ বছরের অপেক্ষা শেষে তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরল আর্জেন্টিনা।

ফাইনালের দীর্ঘ সময় আর্জেন্টিনা এগিয়ে থাকার পর ৯৭ সেকেন্ডের দুই গোলে সমতা টানেন এমবাপে। অতিরিক্ত সময়ে মেসির দ্বিতীয় গোলে আর্জেন্টিনা ফের এগিয়ে যাওয়ার পর ৩-৩ সমতা টানেন এমবাপে। এরপর টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে দিয়েগো মারাদোনার উত্তরসূরিদের বাজিমাত।

চোট কাটিয়ে ফেরা আনহেল দি মারিয়া আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করলেন বড় মঞ্চের তারকা হিসেবে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ঊরুতে আঘাত পেয়ে ছিটকে যান তিনি। নকআউট পর্বের প্রথম তিন ম্যাচে খেলতে পারেন মোটে ৯ মিনিট।

শঙ্কা ছিল ফাইনালে খেলা নিয়েও। তবে সব শঙ্কা উড়িয়ে তিনি মাঠে নামলেন শুরু থেকেই, গতি আর বল পায়ে কারিকুরিতে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ছড়ালেন ভীতি। প্রথমে আদায় করে নিলেন পেনাল্টি, পরে দারুণ এক গোলে দলকে বসালেন চালকে আসনে।

টাইব্রেকারে দুই দলের প্রথম শটেই বল জড়ায় জালে। এরপরই দেয়াল হয়ে ওঠেন গোলরক্ষক মার্তিনেস, ঠেকিয়ে দেন কিংসলে কোমানের শট। তাদের তৃতীয় শট বাইরে মারেন অহেলিয়া চুয়ামেনি। সবশেষে আর্জেন্টিনার চতুর্থ শটে গনসালো মনতিয়েল লক্ষ্যভেদ করতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে আর্জেন্টিনা। ঢেউ ওঠে লুসাইলের নীল-সাদা ঢেউয়ে।

পরিসংখ্যানের পাতায়ও ফুটে উঠছে ম্যাচটি কতটা রোমাঞ্চকর ছিল; একই সঙ্গে আর্জেন্টিনার দাপট এবং ফরাসিদের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্রও। বল দখলে একটু এগিয়ে আর্জেন্টিনা, আক্রমণে অনেক। গোলের উদ্দেশ্যে তারা শট নিয়েছে ২০টি, লক্ষ্যে ১০টি। এই দুই জায়গাতেই ফ্রান্স অর্ধেক; ১০ শটের পাঁচটি লক্ষ্যে। ফাউলও হয়েছে ঢের; আর্জেন্টিনা ফাউল করেছে ২৬টি, ফ্রান্স ১৯টি।

ফাইনালের চাপ এদিন যেন ম্যাচ শুরু হতেই ঝেড়ে ফেলে মেসি-দি মারিয়ারা। আক্রমণাত্মক ফুটবলে পঞ্চম মিনিটে গোলের উদ্দেশ্যে প্রথম শট নেয় তারা। যদিও আলেক্সিস মাক আলিস্তেরের গোলরক্ষক বরাবর শট জমে যায় উগো লরিসের হাতে।  দশম মিনিটে লরিসকে তার ক্লাব সতীর্থ ক্রিস্তিয়ানো রোমেরো ধাক্কা দিলে ফাউলের বাঁশি বাজান রেফারি। বুকে আঘাত পেয়ে বেশ কিছু সময় পড়ে থাকেন লরিস। কিছুক্ষণ পড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি, কেটে যায় শঙ্কা।

সপ্তদশ মিনিটে নিশ্চিত সুযোগ পান দি মারিয়া। কিন্তু মেসির পাস ফাঁকায় পেয়ে উড়িয়ে মারেন চোট কাটিয়ে ফেরা ইউভেন্তুস মিডফিল্ডার। এর খানিক পর তার সৌজন্যেই এগিয়ে যাওয়ার পথ পেয়ে যায় তারা।  ২১তম মিনিটে বাঁ দিক থেকে উসমান দেম্বেলেকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন দি মারিয়া। পেছন থেকে তাকে হালকাভাবে ধাক্কা দেন বার্সেলোনা ফরোয়ার্ড, তবে তাতেই পড়ে যান দি মারিয়া। সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির বাঁশি বাজান তিনি।

সিদ্ধান্তটি নিয়ে উঠতে পারে প্রশ্ন, ধারাভাষ্যকারদেরও বলতে শোনা যায়, হয়তো ভিএআরে পাল্টে যাবে সিদ্ধান্ত। যদিও তেমন কিছু হয়নি। ঠাণ্ডা মাথায় নিখুঁত স্পট কিকে জালে বল পাঠান মেসি।  প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার-ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে গোল করলেন মেসি।

৩৬তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করা গোলে অবশ্য কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। এখানেও জড়িয়ে মেসির নাম। মাঝমাঠে তিনি ছোট্ট কিন্তু সুন্দর এক টোকায় পাস বাড়ান ডান দিকে, বল ধরে হুলিয়ান আলভারেস এগিয়ে গিয়ে সামনে বাড়ান মাক আলিস্তেরকে। তার পাস বক্সে বাঁ দিকে ফাঁকায় পেয়ে কোনাকুনি শট নেন দি মারিয়া। ঝাঁপিয়ে পড়া লরিসকে ফাঁকি দিয়ে বল খুঁজে নেয় ঠিকানা।

গত বছর কোপা আমেরিকার ফাইনালে তার একমাত্র গোলেই ব্রাজিলকে হারিয়ে ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটায় আর্জেন্টিনা। ফ্রান্সের আক্রমণভাগে দারুণ কার্যকর সব নাম থাকলেও তাদের যেন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। কিলিয়ান এমবাপে তো ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। আসরে চার গোল করা জিরুদও তাই। আক্রমণে নতুন জ্বালানি যোগ করতে ৪১তম মিনিটে জোড়া পরিবর্তন করেন দেশম; জিরুদ ও দেম্বেলেকে তুলে রন্দাল কোলো মুয়ানি ও মার্কাস থুরামকে নামান।

ঘর সামলাতে ব্যস্ত ফ্রান্স বিরতির আগ পর্যন্ত গোলের উদ্দেশ্যে কোনো শটই নিতে পারেনি। যেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে আর্জেন্টিনা শট নেয় ৬টি, যার ৩টি থাকে লক্ষ্যে।  বিরতির পর পাল্টা আক্রমণের চেষ্টায় উঠতে থাকে ফ্রান্স। তবে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারছিলেন না এমবাপে-গ্রিজমানরা।

৫৯তম মিনিটে ম্যাচের লাগাম পুরোপুরি হাতে নেওয়ার সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু দি মারিয়ার পাস ধরে বক্সে ঢুকে কোনাকুনি শট নেন আলভারেস। ঝাঁপিয়ে কোনোমতে ঠেকান লরিস। পরের মিনিটে আবারও দি মারিয়ার নৈপুণ্যে, বাঁ দিক থেকে বল পায়ে কারিকুরিতে একজনকে কাটিয়ে বক্সের মুখে বল বাড়ান তিনি। তবে পায়ে বল পেয়েও প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জের মুখে শট নেওয়ার জায়গা বের করতে পারেননি মেসি।
মেসির হাতে বিশ্বকাপ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা

৬৮তম মিনিটে প্রথম গোলের উদ্দেশ্যে কোনো প্রচেষ্টা নেয় ফ্রান্স। অবশ্য গ্রিজমানের কর্নারে কোলো মুয়ানির চেষ্টা লক্ষ্যে থাকেনি। তিন মিনিট পর ভীতি ছড়ান এমবাপে। ডি-বক্সে একজনকে কাটিয়ে তার নেওয়া শটও উড়ে যায় ক্রসবারের ওপর দিয়ে।  প্রতিপক্ষের আক্রমণে কোণঠাসা ফ্রান্স দুই মিনিটের অবিশ্বাস্য এক ঝড়ে পাল্টে দেয় ম্যাচের গতিপথ।

বদলি নেমে শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ফুটবল খেলছিলেন কোলো মুয়ানি। ৭৯তম মিনিটে দারুণ নৈপুণ্যে ওতামেন্দিকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি। পেছন থেকে তাকে টেনে ধরে ফেলে দেন নিকোলাস ওতামেন্দি, বাজে পেনাল্টির বাঁশি।

এমবাপের স্পট কিকে ঠিক দিকেই লাফ দেন গোলরক্ষক মার্তিনেস। বলেও হাত ছোঁয়ান তিনি। কিন্তু আটকাতে পারেননি।

গোল পেয়ে খুঁজে ফেরা আত্মবিশ্বাসও যেন ফিরে পায় ফ্রান্স। যার প্রমাণ পরের মিনিটে ওঠা আক্রমণে। স্বরূপে ধরা দেন এমবাপে। মেসির হারানো বল ধরে শাণানো আক্রমণে থুরামের বাড়ানো বল বক্সে পেয়ে দারুণ ভলিতে স্কোরলাইন ২-২ করেন এমবাপে।

পঞ্চম খেলোয়াড় হিসেবে দুটি বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করলেন এমবাপে। তবে তার চেয়ে কম বয়সে (২৩ বছর ৩৬৩ দিন) এটি করতে পারেননি আর কেউ।

সমতায় ফেরার পর বিধ্বংসী হয়ে ওঠে ফ্রান্স। করতে থাকে একের পর এক আক্রমণ। তবে নির্ধারিত সময়ে আর সাফল্যের দেখা পায়নি তারা। আট মিনিট যোগ করা সময়ের শেষ দিকে ব্যবধান গড়ে দেওয়ার নিশ্চিত সুযোগ তৈরি করেন মেসি। তবে তার বুলেট গতির শট ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে দেন লরিস।

১০৪তম মিনিটে দারুণ দুটি সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। আগের মিনিটে আলভারেসের বদলি নামা লাউতারো মার্তিনেস বক্সে বল পেয়ে নেন জোরাল শট, কিন্তু দারুণ ট্যাকলে রুখে দেন দায়দ উপেমেকানো। ফিরতি বল পেয়ে গনসালো মনতিয়েলের শট হেডে কর্নারের বিনিময়ে ফেরান ভারানে।  পরের মিনিটে আবারও ভীতি ছড়ায় আর্জেন্টিনা, এবার মার্তিনেস বক্সে ঢুকে পড়লেও উপেমেকানোর চ্যালেঞ্জে শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি ইন্টার মিলান স্ট্রাইকার।

১০৮তম মিনিটে ডান দিক থেকে মার্তিনেসের বুলেট গতির কোনাকুনি শট কোনোমতে ফেরান লরিস, তবে বল হাতে রাখতে পারেননি তিনি। গোলমুখে বল পেয়ে ডান পায়ের টোকায় দলকে উচ্ছ্বাসে ভাসান মেসি। জাতীয় দলের হয়ে মেসির গোল হলো ৯৮টি। বিশ্বকাপে তার গোল ১৩টি, ছাড়িয়ে গেলেন পেলের ১২ গোল; বসলেন ফরাসি গ্রেট জুস্ত ফঁতেনের পাশে।  তবে তাদের উল্লাস থেমে যায় ১১৮তম মিনিটে। আরেকটি সফল স্পট কিকে আরও একবার সমতা টানেন এমবাপে। গনসালো মনতিয়েলের হাতে বল লাগলে পেনাল্টিটি পায় ফ্রান্স।

এ যাত্রায় তিন মিনিট যোগ করা সময়ের মাঝামাঝি ব্যবধান গড়ে দেওয়ার সুযোগ পান কোলো মুয়ানি। তবে তার শট অসাধারণ দক্ষণতায় পা দিয়ে ফেরান মার্তিনেস। পরের মিনিটে আবারও এমবাপে ঝড়, বাঁ দিয়ে দুজনকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে আরেকজনকে কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত বল হারিয়ে ফেলেন ‘হ্যাটট্রিক ম্যান।’ এরপর পেনাল্টি শুটআউটে উত্তেজনা, কোমান-চুয়ামেনির ব্যর্থতা, মেসি-দি মারিয়ার পাশে মার্তিনেসের পার্শ্ব নায়ক হয়ে ওঠা এবং সবশেষে রেকর্ড সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি। অপেক্ষা ঘুচল আর্জেন্টিনার। কিংবদন্তির মারাদোনার পাশে বসলেন মেসি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কাতার বিশ্বকাপ, লিওনেল মেসি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন