পর্যটন শিল্পে আবারো অশনি সংকেত হরতাল-অবরোধে হাজার কোটি টাকা লোকসান: ছাটাই আতংক
স্টাফ রিপোর্টার:
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রামু ট্রাজেডির কারণে বিগত ২০১২-২০১৩ সালে চরম বাজে অবস্থা পার করেছিল পর্যটন ব্যবসায়ীরা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কয়েক মাস পর থেকে রাজনীতিতে স্বাভাবিকতা ফেরার লক্ষণ দেখে সবার মাঝে আশার সঞ্চার হয়। এতে বাদ যায়নি পর্যটন ব্যবসায়ীরাও।
দু’বছরের কঠিন গ্লানি কাটিয়ে গত বছরের ঈদুল ফিতরের পর থেকে পর্যটনে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দেখতে পান তারা। কিন্তু এ শুভ সূচনার যাত্রা দীর্ঘায়িত হবার পূর্বেই আবারো শনির দশায় আটকে গেছে লাখো মানুষের কর্মযজ্ঞ।
২০১৫ সালের প্রথম দিন হরতাল দিয়ে অশুভ সূচনার পর ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ, মাঝে মাঝে হরতাল ভরা মৌসুমেও পর্যটন স্পট গুলোকে জন-মানব শূন্য করে দিয়েছে। এতে করে আবারো দেখা দিয়েছে পর্যটন শিল্পে অশনি সংকেত। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে অনেক হোটেল-মোটেল-রেস্তোরা ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। যার ফলে জেলার পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক কর্মজীবীর মাঝে বিরাজ করছে ছাটাই আতংক। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘায়িত হলে এ শিল্পে হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি ও তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস’র চেয়ারম্যান লায়ন এম.এন করিম বলেন, দেশের অপার সম্ভাবনাময় একটি শিল্প পর্যটন। বিশ্বের দীর্ঘতম অখণ্ড বালিয়াড়িকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারেই এ শিল্প বিকাশের সুযোগ রয়েছে। এখানে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করতে উদ্দোক্তা হিসেবে আমরা সমুদ্রপারে হাজার কোটি টাকা গেড়ে ফেলেছি। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে থেমে থেমে যে অশুভ কাণ্ড দেশে ঘটছে তাতে এখানে বিনিয়োগকারীরা চোখে সর্ষের ফুল দেখছেন।
এখন পর্যটনের ভরা মৌসুম। এ সময় পর্যটকে টৈ টম্বুর থাকার কথা পুরো সৈকত এলাকা। স্বাচ্ছন্দে পর্যটক আসতে পারলে দু’পয়সা আয় করা যেত। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সময়মতো বেতন ভাতা প্রদানের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এখন পুরো পর্যটন এলাকা মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। ব্যাংক ঋণ দূরে থাক, হোটেলে কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা পরিশোধ, তিন বেলা খাবার এবং আনুসাঙ্গিক খরচ মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাধ্য হয়ে হোটেল বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকবে না আমাদের।
এমনকি সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত মতে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব সদস্যদের পাহারায় পর্যটক সহ যাত্রীবাহী বাসগুলো চলাচল করছিল। কিন্তু পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর অহরহ চিত্র প্রচার পাওয়ায় ভ্রমণে বের হতে সাহস পাচ্ছে না পর্যটকরা। আর বিমানে যারা আসছে তা পর্যটনের ভরা মৌসুমের জন্য উল্লেখযোগ্য নয়।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব ওমর সোলতান বলেন, বিগত ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজসহ পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিলেন। এ বছর সেই ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কক্সবাজারের সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল পর্যটকদের জন্য নানা প্রস্তুতি নেয়। গত থার্টি ফার্স্ট নাইটের আগে ও পরে আশানুরূপ পর্যটক আসলেও এখন প্রায় পর্যটক শূন্য। বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিশীলতা, হরতাল ও অবরোধের কারণে আশায় গুড়েবালি হয়েছে। ফলে আবারো হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, আবাসিক ও রেস্তোরা খাতে প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। কক্সবাজার আবাসিক হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউজ শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্র জানায়, হরতাল-অবরোধের কারণে পর্যটক শূন্যতা বিরাজ করায় মালিক পক্ষ অনেককে বাধ্যতামূক ছুটি দিয়েছেন। ফলে হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউজের সাথে জড়িত প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী অসহায় দিন যাপন করছেন।
কক্সবাজার হোটেল ও রেস্তোরা মালিক সমিতির কর্মকর্তা টিটু জানান, পর্যটক শূন্যতার কারণে হোটেল-মোটেল জোন এলাকার প্রায় ৩ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ১৫ হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী বেকার সময় কাটাচ্ছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহমেদুল কবীর বলেন, ডিসেম্বরে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। এখন ফাঁকা সৈকতে পুলিশ সদস্যদের অলস সময় কাটাতে হচ্ছে।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইজের রুম ডিভিশন ম্যানেজার (আরডিএম) মজিদুল আলম বলেন, বিক্রয় যোগ্য মোট ২০০ কক্ষের মধ্যে বুধবার তাদের মাত্র ২০টি কক্ষে অতিথি ছিল। ৫০% ডিসকাউন্ট দেয়ার পরও রুম বিক্রি করা দূরহ হচ্ছে। বিগত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হোটেলটিকে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনেছিল।
ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন কক্সবাজার (টুয়াক) সাধারণ সম্পাদক আসাফদ্দৌলা আশেক জানান, গত ১৭ জানুয়ারি টেকনাফ হতে কেয়ারী সিন্দাবাদ জাহাজ যোগে ৬০-৭০ জন পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গেছেন । পর্যটনের ভরা মৌসুমে ৬-৭ টি জাহাজ যোগে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ হতে ৫ হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যেত। ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি সেন্টমার্টিনের উদ্দ্যেশ্যে কোন জাহাজ ছেড়ে যায়নি।
গত বুধবার বিকেলে সৈকতে গিয়ে দেখা গেছে, যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই প্রায় ফাঁকা। পর্যটকের বসার ছাতা-চেয়ারগুলো খালি পড়ে আছে। ছাতার মালিক আবদুল মান্নান বলেন, জানুয়ারির প্রথম দিন হরতাল হলেও টানা তিন দিন সৈকতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ভিড় ছিল। আর এখন একজনও নেই। এ কারণে কয়েক’শ শ্রমজীবী বেকার হয়ে পড়েছেন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধের মাঝেও কক্সবাজারের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।