পার্বত্য চট্টগ্রাম সমাচার

পার্বত্য-চট্টগ্রাম

আনিসুল হক 

‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির জন্য মাত্র কয়েক বছর থেকে সন্তু বাবুর লোকজন উঠেপড়ে লেগেছেন। অথচ এর সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, এটা তাদের কাছে অর্থহীন ও মূল্যহীন। ধরে নিলাম এ অতি লোভনীয় (সন্তু বাবুর দৃষ্টিতে) দাবিটি সরকার মেনে নিলে পার্বত্য জাতিসত্তার ঝুড়িতে কি নতুন কিছু ঝলমল করবে? যে দাবিটি নব্বই পর্যন্ত ছিল না, শান্তিচুক্তিতে তা উল্লেখ করা হয়নি। চাকমা, হিন্দু এবং যে ইংরেজরা তাদের শাসন করেছে, ১৯০০ সালের বিধি জারি করেছে, তাদের পাকিস্তানভুক্ত করে দিয়েছে তারা কোথাও ‘আদিবাসী’ উল্লেখ করেনি। এরা প্রত্যেকে লিখেছে পার্বত্যবাসীরা আশপাশের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অথবা পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তাও প্রথমে এখানে আসেনি, চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তারপর এখানে থিতু হয়েছে। শুধু এখানে কেন, এদের কিছু এখনো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং বরিশালে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। প্রায় পৌনে ৪০০ বছর আগে খড়কুটার মতো ভেসে ভেসে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়ে স্থিতু হওয়াকে কি আদিবাসী বা এ দেশের ভূমিজ সন্তান বলা যায়? এর পেছনে কলকাঠি নাড়া শুরু করেছিল পাকিস্তানি নাগরিক সাবেক চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় (প্রয়াত)। একে টেনে চলেছে তার ছেলে বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়, তার বোন চন্দ্রা কালিন্দী রায়। চন্দ্রা রায় নিজে লেখার মতো যোগ্যতা রাখেন না। তার নামে লেখা চালিয়েছেন রাজা ত্রিদিব রায় আর এখন রাজা দেবাশীষ রায়। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দেশের বামপন্থী রাজনীতিকরা একই দর্শনে বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীরা। সারা দেশে এদের সমর্থন ২%ও নেই। আর আছে ভেতর ও বাইরের এনজিও গোষ্ঠীর দালালরা।

২০১৪ সাল থেকে মাওবাদীরা ভারতের ২২ রাজ্যে সরকারকে বেসামাল করে তুলেছে। পার্বত্যাঞ্চলের মাওবাদী দল ইউপিডিএফও কি একই ভূমিকা পালন করতে চাচ্ছে? সময় থাকতে এদের কঠিনভাবে দমন না করলে সরকারকে মূল্য দিতে হবে। পার্বত্য সমস্যার মুখ্য কারণের হলো এনজিও গোষ্ঠী, এরা পার্বত্যাঞ্চলের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত, রাষ্ট্রবিরোধী কাজও করছে, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পাচারেও লিপ্ত, পাহাড়ি এবং অ-উপজাতির মধ্যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির নায়ক এরা। পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়িদের খ্রিস্টান বানিয়ে চলছে নির্দ্বিধায় এবং ইংরেজি শেখানো হচ্ছে। কোনো কোনো গোত্র বা সম্প্রদায়কে পুরোপুরি খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলছে। এদের ছোট ছেলেমেয়েরাও ইংরেজিতে কথা বলে।

অন্য মিডিয়া

স্বাধীনতার পর যেসব অ-উপজাতি একেবারে শূন্য হাতে পার্বত্যাঞ্চলে আত্মগোপন করেছিলেন তারা এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও সম্পত্তির মালিক। তারা অপকর্ম ও জোচ্চুরি করেই এ অবস্থানে পৌঁছেছেন। আর তাদের সঙ্গে আছে মিয়ানমারের কিছু দস্যু। পাহাড়িরা সব জেনেও এদের সম্পর্কে একটি টুঁশব্দ করে না। কারণ মোটা দাগের টাকা ও মাসিক চাঁদা। মূলত পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি ও সাধারণ অ-উপজাতির মধ্যে আমি বিশেষ কোনো সমস্যা দেখিনি। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা যেমন এখানেও তা। শুধু ব্যতিক্রম ওই বিশেষ গোষ্ঠী, যার ওপর একটা পূর্ণাঙ্গ বই লেখা যায়। তাদের অপরাধের শিকার হয়ে পড়েছে সাধারণ অ-উপজাতিরা।

পৃথিবীর প্রায় নব্বই ভাগ দেশের আদিবাসী/উপজাতি/পাহাড়িরা স্বভাব-চরিত্র কৃষ্টি-সংস্কৃতি, আচার-আচরণে অনেকটা মিল দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশসহ মাত্র কয়েকটি দেশের একটি প্রবণতা হলো সংসার জীবনে ও কাজে অর্থাৎ ঘরে, চাষে, পাহাড়ে ও বাজারে নারীদের দিয়ে কাজ করানো। এর উদ্দেশ্য নারীর যৌনস্পৃহা কমানো। এ কারণে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়িদের পরিচিতিতে ‘নারীর’ নামকরণ ব্যবহার করে। পুরুষরা অকর্মণ্য, অপদার্থ, নেশা আর আমোদ-প্রমোদে ডুবে থাকে। সাধারণ উপজাতিরা সহজ-সরল। তাদের কোনো হা-হুতাশ নেই, চাহিদা নেই, জিজ্ঞাসাও নেই। সমস্যার নায়করা হলো শিক্ষিত ও সাধারণ পড়ালেখা জানা ছেলেরা। একসময় এদের বিভ্রান্তির নায়ক হয়ে ওঠেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়।

জাতিসংঘ! প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব দেশ বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে জন্তু-জানোয়ারের মতো হত্যা করেছে তারাই এ জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা। এর প্রতিষ্ঠার পরও পৃথিবীব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে নিধন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অতএব এ সংস্থাটি সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর এবং প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলোর বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। তারা আদিবাসীর নতুন সংজ্ঞা বের করল কিন্তু পুরনো আদিবাসী যারা প্রকৃত অর্থে ভূমিজ সন্তান এবং যাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস আছে তাদের ভাগ্যে কী ঘটল? ব্রিটিশরা আইরিশদের ওপর বর্বর অত্যাচার চালিয়েছিল। টিকে থাকার জন্য নূন্যতম অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। এরাই আমেরিকা অধিকারের নামে লাখ লাখ রেড ইন্ডিয়ান হত্যা করেছিল। আজ বিশ্বপ্রভু আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ান আর কালোরা কী অবস্থায় আছে অথবা আমেরিকার আদিবাসীরা কী অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে? কালো, আদিবাসী সবাই সাদাদের দ্বারা সব সময় নিগৃহীত হচ্ছে। তারা সার্বিক দিক থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে। শিক্ষা, চাকরি, আর্থিক দিক থেকে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে আছে। শুনে অবাক হওয়ার মতো, অনেক রেড ইন্ডিয়ানের নিজের বাড়ি বলতে নেই অথচ জাতীয় উন্নয়নে এরা অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
আমাদের আশপাশের কয়েকটি দেশের উপজাতি কি আদিবাসী থেকে পাহাড়ি সম্প্রদায় অনেক ভালো আছে। এমনকি আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ান থেকে ভালো তো বটেই।

১. দয়া এবং করুণার বশবর্তী হয়ে হাসিনা সরকার শান্তিচুক্তি করেছিল কিন্তু সন্তু লারমারা প্রতারণা করেছেন। শান্তিবাহিনীর সবাই যেমন আত্মসমর্পণ করেনি, তেমনি সব অস্ত্র জমা দেয়া হয়নি। ‘করুণা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি এ কারণে যে, দেশে-বিদেশে তাদের সমর্থন শূন্য পর্যায়ে নেমে এসেছিল। যেমন দেশে চাঁদা দেয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর ভারতে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল। ফলে ভারত সরকার তাদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং শান্তিবাহিনীকে দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়। এ কারণে চুক্তি হলে পার্বত্য উপজাতিদের মধ্যে কয়েক দিন উৎসবের বন্যা বয়ে যায়। কারণ একটিই, আর চাঁদা দিতে হবে না।
২. চুক্তির ধারায় বার বার পরিবর্তন, সংযোজন এবং নতুন ধারা যোগ করা নিয়ে বিষয়টি প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
৩.পার্বত্যাঞ্চল জনগোষ্ঠীর অর্ধেক অ-উপজাতি হলেও ভূমি কমিশনে কোনো অ-উপজাতি সদস্য না রাখা, একদিকে মারাত্মক ভুল অন্যদিকে সন্তু লারমার কৌশলী চক্রান্ত; যা শান্তির স্থলে অশান্তিকে প্রশ্রয় দেবে, পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। পার্বত্যাঞ্চলের মূল সমস্যা ভূমি এবং চাঁদাবাজি। কিন্তু ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে অনেকবার চেষ্টা করেও ভূমি সমস্যার সমাধান করা যায়নি। পর্দার অন্তরালে এর মূল চাবি রাজা, হেডম্যান ও কারবারিদের হাতে। জমি যদি ব্যক্তি মালিকানায় চলে যায় তাহলে তারা যে খাজনা পায় এবং সরকার যে আর্থিক সুবিধা দেয় তা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন রাজা, হেডম্যান, কারবারির সব কারবার বন্ধ হয়ে খাঁখাঁ মাঠে পরিণত হবে।

ব্রিটিশ শাসিত পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়িদের জন্য যে ১৯০০ বিধি জারি করেছিল তা কথিত রাজাদের রক্ষাকবচ। নিয়মিত কর দেয়া ছাড়াও সাধারণ পাহাড়িদের করে দেয়া হয়েছিল আজীবনের দাস। তাদের কাজ করতে হবে বিনা পারিশ্রমিকে যতক্ষণ, যত সময় ও যতদিন হোক না কেন, তা কোনো ব্যাপার নয়। রাজারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়ে, জলুস বৃত্তে নিজেদের ডুবিয়েছে, রাজাধিরাজ হয়েছে কিন্তু জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণে কী কাজ করেছে? এমন একটি উদাহরণ পাওয়া যাবে কি? রাজনীতিকদের বেলায়ও একই কথা খাটে। তারা পার্বত্যবাসীর জন্য কিছুই করেনি। তারা শুধু নিজের বিত্ত-বৈভব বাড়ানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের মধ্যে এ পর্যন্ত সবচেয়ে দামি গাড়ি বিদেশ থেকে আমদানি করেছিলেন মদ-জুয়ার আসরের পণ্ডিত পার্বত্য এক সংসদ সদস্য।

৪.পাহাড়িরা বলে পার্বত্যাঞ্চলে সেনা শাসন, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ নির্বিচারে চালিয়েছে। যদি তাই হতো তাহলে পার্বত্যাঞ্চলে এত উন্নয়ন, শিক্ষার উচ্চহার বিশেষ করে চাকমা ও ত্রিপুরাদের মাঝে কিভাবে সম্ভব হলো? সচিব, আইজিপি, রাষ্ট্রদূত এবং জেনারেল হলো কিভাবে? ম্যাট্রিক পাস করে প্রথম শ্রেণির চাকরি, দুটি তৃতীয় বিভাগ নিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়া ইত্যাদি তো সম্ভব হয়েছে সেনাবাহিনীর কল্যাণে। এগুলোতে চাকমারাই বেশি সুবিধাভোগী।

৫.বিসিএস ক্যাডারে কোটা পদ্ধতির কারণে সামগ্রিক প্রশাসন মেরুদ-হীন জোঁক হয়ে পড়েছে। এ প্রথা ভেঙে নন ক্যাডারভুক্ত প্রথম শ্রেণির সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে উপজাতি, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য তা চালু করা যেতে পারে। উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত কোটা সব উপজাতির জন্য কিন্তু এখানে সব কিছু লুফে আর লুটে নিচ্ছে চাকমা, কিছু ত্রিপুরা সম্প্রদায়। এরা তো সব শ্রেণি-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। আসলে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্ট সব সমস্যার মূলে কাজ করেছে এবং করে যাচ্ছে। পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তিতে প্রথম বিরোধিতা করেছে তারা। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাক সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানান পার্বত্যাঞ্চলে। তিনি তাদের অভ্যর্থনা জানান এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন। যারা পরবর্তীতে শান্তিবাহিনী গঠন করে। বিদ্রোহেরও সূত্রপাত তাদের হাতে। অন্য দেশে আশ্রয় নেয় তারাই, যে দল গঠন ও সশস্ত্র সংগঠনে নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সব পদেই তারা। ছাত্র সংগঠনেও একই অবস্থা। ঝড়-ঝাপটায় এখন কিছু পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। তাদের সম্মেলন এবং দাবি-দাওয়ার মধ্যে ১০টি উপজাতির কথা উল্লেখ ছিল। তাহলে বুঝুন তারা কী মানসিকতার। গারো, অহমিয়া, রাখাইন, সাঁওতাল, গুর্খারা বাদ পড়ল কেন?

৬. শিক্ষকের অনেক ছাত্রছাত্রী থাকে কিন্তু শিক্ষক সীমিত। ফলে শিক্ষকের পক্ষে সব ছাত্রছাত্রীকে চেনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তবে ছাত্রছাত্রীর কাছে তা হওয়ার নয়। কয়েক মাস আগে আমি পার্বত্যাঞ্চলে গিয়েছিলাম, গোপনে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা ছিলাম। সন্তু লারমার শহরটা দেখে অবাক বা হতভম্ব হইনি কারণ রাজধানী শহরই তো আস্ত বস্তি। অতএব একসময় যে অঞ্চলকে সার্বিক অর্থে সৌন্দর্যের লীলাভূমি উল্লেখ করে বই লিখেছিলাম আজ তাকে কটাক্ষ করি কিভাবে। এ কারণে সব কিছু এড়িয়ে এক চাকমা কাপড়ের দোকানে প্রবেশ করলাম। মুহূর্তের মধ্যে বয়স্ক থেকে বুড়ো লোকজন পা ছুঁয়ে সালাম শুরু করল। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তারা আমার ছাত্র। একজন আমার সঙ্গই ছাড়তে চাইছে না। তার বাসায় যেতে, খেতে, থাকতে হবে ইত্যাদি। আর এক পরিচয় ছিল তার, পাহাড়ি বড় দলের বড় নেতা।

আমি যখন স্ত্রীসহ গাড়িতে উঠলাম, সেও উঠে বসল। এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় আমি সিরিয়াসভাবে পাহাড়ি-অ-উপজাতি সম্পর্ক এবং সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে জানাল এ দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। এখানকার আসল সমস্যা পাহাড়ি দুই দলের চাঁদাবাজি। সব স্তরের মানুষকে সব কিছুর জন্য দুই দলকেই চাঁদা দিতে হয় ব্যধ্যতামূলকভাবে। এতে লোকজন খুবই ক্ষুব্ধ কিন্ত ভয়ে কিছু বলতে পারে না। এ অবস্থায় একদিকে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার হুমকি অন্যদিকে ইউএনডিপির ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অ-উপজাতিদের পার্বত্যাঞ্চলের বাইরে পুনর্বাসনের প্রস্তাব-প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি ও সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা মাত্র। ইউএনডিপির আচরণ অসংযত এবং অভব্য। এ ব্যাপারে সদাশয় সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

৭.পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর নাড়ির সঙ্গে এ দেশের মাটির কোনো সূত্র নেই। ওরা পলাতক এবং আশ্রিত। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, আলীকদম এবং শেষে চট্টগ্রামের রাজানগর হয়ে এরা পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তখন অ-উপজাতীয়ও ছিল, তাদের যাতায়াত ও ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক কে করেছে? কারা রক্ত ঝরিয়েছে? উত্তর অ-উপজাতি। ব্রিটিশ আমলে জমি চাষ করা ও শেখানোর জন্য ১২০ অ-উপজাতি পরিবার পার্বত্যাঞ্চলে নেয়া হয়েছিল।  আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন ঘটেছে তার মূলে অ-উপজাতি। তারা রাস্তাঘাট তৈরি করেছে, কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখন সেখানে বড় বড় নৌকা তৈরি করে অ-উপজাতিরা।

পাহাড়িদের মধ্যে তাদের ঐতিহ্য ধারা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি বলতে তেমন কিছু নেই। এখন এখানে শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত সবাই বাংলায় কথা বলে। শুধু গহিন অরণ্যে কিছু আছে যারা নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে। এর মধ্যে চাকমা ভাষা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির চাপে অন্য ভাষাগুলো বিলুপ্তির পথে। আসলে তাদের নিজস্ব ভাষা বলতে কিছু নেই। যা আছে তা মিয়ানমারের ভাষা। তার পরও চাকমা ও মারমা ভাষায় বই লিখে রাঙামাটি সরকারি হাইস্কুলে ব্রিটিশ আমলে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু পারা যায়নি এবং এর বিরুদ্ধে কিছু পাহাড়ি যুবক আন্দোলনে নামে প্রধান শিক্ষককে অপমান-অপদস্থ করে। সব শেষে ছাপানো সে বই পুড়িয়ে ফেলে তারা। রাজবাড়ির সামনে শিল্পকলা একাডেমিতে সব ভাষা শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল বাংলাদেশ আমলে, তাও বন্ধ হয়ে যায়। ফড়িয়া এনজিওগুলো তাদের প্রায় ডুবন্ত উৎসবগুলো নিয়ে মাতামাতি করে। পুরাতন বছরের বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ তাদের মনে-প্রাণে স্পন্দন জোগায়। এটাই তাদের একমাত্র প্রাণশক্তি। সেখানে সন্তু থাবা মারল, উৎসবের নাম দিল ‘বৈসাবি’। পাহাড়ি বন্ধুরা আপনারা এ দেশের নাগরিক, আপনারা আমাদের ভাই। আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র সুপ্রশস্ত পথ। ‘বৈসাবি’ হত্যাযজ্ঞে নৃত্য করে ‘আদিবাসী’ জপমালা কি শোভা পায়? (সূত্র: যায়যায়দিন)

♦ আনিসুল হক: অধ্যাপক ও গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমাচার”

  1. পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালা ১৯০০ অনুযায়ি ডেপুটি কমিশনারকে সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থার যাবতীয় বিষয়ে তাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এই বিধিমালায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের নাগরিক অধিকার বঞ্চিত করে আশ্রিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া তাদের ভূমি অধিকার ছিল না। উপজাতীয় কারবারিদের শুধু যাযাবর জুম চাষের পাঁচসালা বিলি ব্যবস্থা ও বন্য প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের ভার দেয়া হয়। বাঙালিদের দেখাদেখি খুবই সামান্য সংখ্যক উপজাতীয় হালচাষ রপ্ত করে। বিধিমালায় স্পষ্ট করে লেখা ছিল উপজাতীয়রা পঁচিশ বিঘা জমি ব্যাবহার করতে পারবে, কিন্তু জমির মালিক হতে পারবে না। বিচারালয়ে কোন উকিল থাকবে না। সার্কেল চীফ (রাজা), হেডম্যান ও কারবারিরা থাকবে। দরকার হলে উপজাতীয়রা বিনা পারিশ্রমিকে সরকারি কর্মকর্তাদের চাহিদা মোতাবেক কাজ করে দিতে বাধ্য থাকবে। সার্কেল চীফ (রাজা), হেডম্যান এমনকি কারবারিরাও তাঁর অধীনস্থ উপজাতীয়দের খাটাতে পারবে কোন পারিশ্রমিক না দিয়েই। এই বিধিগুলো সাধারন পাহাড়িদের উপকার করবে, নাকি এলিটদের? কিন্তু এই বিষয় গুলো উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা গোপন করে রাখছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন