মাটিরাঙ্গা উপ‌জেলার রসুলপুরে একখন্ড মরুর প্রান্তর

পাহা‌ড়ের বু‌কে নান্দনিক মরুর ফল বাগান, ড্রাগন চাষেও সফলতা

fec-image

পার্বত্য খাগড়াছ‌ড়ির মাটিরাঙ্গা উপ‌জেলা সদর হ‌তে আকাঁবাঁকা পাহা‌ড়ি পথ ধ‌রে প্রায় তিন কিলোমিটার গেলেই রসুলপুর। চির সবু‌জ পাহা‌ড়ের বুক ছি‌ড়ে গভীর অরণ্য ভেদ করে দাড়ি‌য়ে আ‌ছে মরুভু‌মির চিরল পাতার সা‌রিবদ্ধ ছোট ছোট খেজুর গাছ। এ যেন পাহা‌ড়ের বু‌কে একখন্ড মরুর প্রান্তর। ফ‌লে ফু‌লে গাছে গাছে বিদেশি জা‌তের খেজুরের নান্দ‌নিক দৃশ্য মা‌তোয়ারা ক‌রে তো‌লে যে কা‌রো মন‌কে।

পাহা‌ড়ের ঢা‌লে বিদেশি খেজুরের চাষ করে সফলতার মুখ দেখছেন মো. নুর আলম। তার বাগান দেখ‌তে দূর-দুরান্ত থে‌কে ছুটে আসে ভ্রমন পিপাসু, প্রকৃ‌তিপ্রেমী, লেখক, সাংবা‌দিক, গ‌বেষক ,প্রশাস‌নিক কর্মকর্তাসহ নানা শ্রেণীর ও পেশার মানুষ । পাহা‌ড়ের বু‌ক ছেড়া মরুর প্রান্ত‌রের সৌন্দয্য স্মৃ‌তিময় ক‌রে রাখ‌তে কেউ কেউ গা‌ছের সা‌থে একাকার হ‌য়ে ক্যামরা বন্ধি করছেন নিজেদের।

খেজু‌রের পাশাপা‌শি একই জমিতে ড্রাগনসহ বিভিন্ন মিশ্র ফলের গাছ লাগিয়ে সফলতা পেয়েছেন নুরুল আল‌ম। তার সফলতা দে‌খে বাগান কর‌তে আগ্রহী হয়ে উঠায় বিক্রি করা হচ্ছে খেজুরের টিস্যু কালচারের চারা ।

পাহা‌ড়ের কৃ‌ষি‌তে বৈ‌প্লি‌বিক স্বপ্নদ্রষ্টা নুর আলম বলেন, গ্রামীণ জীবনে কৃষি কর্মকাণ্ডে শাইখ সিরাজের কৃষি বিষয়ে অনুষ্ঠান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পার্বত্যাঞ্চলে কৃষির বিপ্লব সৃষ্টি করার ল‌ক্ষ্যে মাটিরাঙ্গার রসুলপুরে ২০১৯ সালে ১৩ একর জমি ক্রয় করে আধু‌নিক প্রযু‌ক্তিতে একই বছর পরীক্ষামূলকভা‌বে বিভিন্ন ফলের বাগান শুরু করি। বর্তমানে এই বাগানে প্রতি‌দিন প্রায় ১০/১২ জন শ্রমিক কাজ করে। এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ৬ হাজার ওয়ার্টের সোলার সিস্টেম চালুর মাধ্যমে বিদ্যুতের চাহিদা পূরন করা হচ্ছে।

দীর্ঘ বছর ধরে সৌদি-বাংলাদেশে আইটি সেক্টরে কাজ করতেন নুর আলম। দাম্পত্য জীবনে এক কন্যা সন্তানের জনক আলম থাকেন ঢাকায়। পাহা‌ড়ে ঘুর‌তে এ‌সে প্রকৃতির প্রেমে পড়া নুর আলম আত্মীয়দের সহ‌যো‌গিতায় পাহাড় ভূমি ক্রয়পূর্বক শুরু হয় পাহাড়ের জমিতে বৈজ্ঞা‌নিক পদ্ধ‌তি‌তে পরিকল্পনানুযায়ী বি‌ভিন্ন ফলের চাষ।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরব থেকে এনে প্রায় ১ শত আল রাজি টিস্যু কালচার খেজুর চারা রোপন করেন নুর আলম। কৃ‌ষি প্রযু‌ক্তির স‌ঠিক ব্যবহারের কার‌ণে মাত্র ৩ বছরে খেজুর গাছে ফল ধরা শুরু হয়েছে। থোকায় থোকায় দুলছে সবুজ ও হল‌দে রংয়ের খেজুর আর বনবন ক‌রে উড়‌ছে মৌমাা‌ছি।

বেরহি, আজওয়া, মিটজল ও আম্বারসহ বিভিন্ন জাতের খেজুর গাছে ইতোমধ্যে ফল ধরা শুরু হয়েছে। চল‌তি বছ‌রে খেজুর বিক্রির লক্ষমাত্রা দেড় লাখ টাকা হলেও আগামীতে আ‌রো বে‌শি উৎপাদন ও বিক্রির আশা করেন তিনি।

পক্ষান্ত‌রে দিন দিন পাহা‌ড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিদেশি ফল ড্রাগনের চাষ। পাহাড়ি জনপদে বাণিজ্যিকভাবে বিদেশি ফল ড্রাগনের চাষ করে স্থানীয় চা‌হিদা মি‌টি‌য়ে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দে‌শের বি‌ভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে হ‌চ্ছে। এ‌তে পাহা‌ড়ের গ্রামীন জীব‌নে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে উঠেছেন অনেকে এবং সৃষ্টি হয়েছে এলাকায় বসবাসরত লোকেদের কর্মসংস্থান।

এরই ল‌ক্ষ্যে খেজু‌রের পাশপা‌শি ২০২০ সালের জুন মাসে ২ একর জমিতে ড্রাগন চাষ শুরু করেন নুর আলম। বর্তমানে ১৭ শত ড্রাগনের প‌রিপক্ক ও ৫ শত চারা গাছ রয়েছে এই বাগানে। সবুজ ,হলুদ ও লাল বাহা‌রি রংয়ের মিলন মেলায় মৌমা‌ছি আর ভোমরার গুনগুনা‌নি প্রজাপ্রতির রং মাখা ডানায় প্রকৃতি যেন একাকার। বায়ু পরাগা‌য়ি খেজুর, ড্রাগন সহ মিশ্রফ‌লের বাগা‌নে পরাগা‌য়‌নে আ‌রো নি‌শ্চিত করার ল‌ক্ষ্যে বাগা‌নের এক‌ কো‌নে করা হ‌চ্ছে প‌রিক‌ল্পিত মোৗমা‌ছির চাষ।

কৃ‌ষিবিধ‌দের ম‌তে একটা মৌমা‌ছি স্বাভা‌বিকভা‌বে ৩‌ তিন কি‌.মি.বিচরণ কর‌তে পা‌রে। এবং এক‌টি মৌচা‌কে ৩০‌ থে‌কে ৪০ হাজার মৌমা‌ছি থা‌কে। ফু‌লে ফু‌লে ঘু‌রে মধু আহরণ কা‌লে পরাগায়ন ঘ‌টে। এ‌তে মিশ্রফ‌লের পবাগা‌য়‌নের নিশ্চতা ও মধু উৎপাদ‌নেও লাভবান হন চা‌ষিরা।

তাছাড়া ৪ প্রজাতির ড্রাগন চাষ করা হয়েছে এই বাগানে। গোল্ডেন ইয়েলো, আমেরিকান বিউটি, তাইওয়ান রেড এবং থাই হোয়াইট। তিন বছরের ব্যবধানে তিনটি মৌসুমে বাগানের ড্রাগন ফল বিক্রি করে আয় করেছেন প্রায় ১৪/১৫ লাখ টাকা।

চল‌তি মৌস‌ম শুরু‌তে ড্রাগন বিক্রি করা হয় প্রায় ২.২৫ লাখ টাকা। শেষ দি‌কে প্রায় ৮/৯ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করা যাবে বলে আশা ক‌রেন‌ তি‌নি।

এছাড়াও বাগানে, চাইনিজ কমলা গাছ, রামভুটান, লংগান, লটকন, মিয়াজাকি আম, গরুমতি, ভিয়েতনামি মাল্টা, কাটিমন আম, মিশরীয় মাল্টা, রিং মাল্টা (বা‌রি-১), আলুবোখারা, আপেল নাসপাতি, এ্যাভোকেটর সহ বিভিন্নজাতের ফলের গাছ রয়েছে ।

তাছাড়া, নতুন আ‌ঙ্গি‌কে পরীক্ষামূলকভাবে লাগানো হয়েছে ব্লাক আম্বর ও ঝাড়া লেবু। আবহাওয়ার ও মাটি উপযোগী হলে ব্যপকভাবে উৎপাদন করা হবে এ দুটি ফল।

সং‌শ্লিষ্ট‌ ব্ল‌কে দা‌য়িত্বরত মাটিরাঙ্গা উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ চাকমা বলেন, এখানকার মাটি ও আবহাওয়া চাষের উপযোগী । তাই এখানে সবুজ বিপ্লব সম্ভব। সে ল‌ক্ষে ২০১৯ সাল থে‌কে নুর আল‌মকে সা‌র্বিকভা‌বে প্রযু‌ক্তিগত সহায়তা দেয়া হচ্ছে। চা‌হিদা মোতা‌বেক সার্বক্ষ‌নিক তদার‌কি করা হ‌চ্ছে ব‌লেও জানান সং‌শ্লিষ্ট‌ কৃ‌ষি কর্মকর্তা।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সবুজ আলী জানান, মা‌টিনাঙ্গার রসুলপু‌রে নুরুল আলম পরীক্ষামূলকভা‌বে ১ একর জ‌মি‌তে খেজুর ও ২ একর জ‌মি‌তে ড্রাগন চাষ করেছেন। ‌খেজুর গা‌ছে ফল এসে‌ছে। প‌রিপক্ক হ‌য়ে‌ছে। তাঁর বাগা‌নের অবস্থা খুব ভা‌লো। পাহা‌ড়ের মা‌টি‌তে সৌ‌দি খেজুর এক‌টি সম্ভাবনাময় ফল। স‌ঠিক পদ্ধ‌তিতে চাষাবাদ কর‌লে সুফল পাওয়া যা‌বে।

ড্রাগনচা‌ষে ই‌তোম‌ধ্যে সফলতা এ‌সে‌ছে। ত‌বে‌ বি‌শেষ ক‌রে খেজুর চা‌ষের ক্ষে‌ত্রে কৃ‌ষি বিভা‌গের পরামর্শ নি‌য়ে চাষ করার জন্য চা‌ষি‌দের প্রতি আহবান জানান তি‌নি।

নিউজটি ভিডিওতে দেখুন:

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: চাষ, ড্রাগন, পাহাড়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন