ফিরে দেখা রাঙামাটির ২০২২

fec-image

পার্বত্য রাঙামাটি জেলার পাহাড়ের ভাঁজে, ভাঁজে দুর্গম জনপদে সারা বছর চলে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। এখানে চাঁদাবাজি, হত্যা, খুন, গুমসহ নানারকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তবে কিছু দুষ্কৃতিকারী ছাড়া পাহাড়ের মানুষ অত্যন্ত শান্তপ্রিয়। তারা সব সময় শান্তির বার্তা খুঁজে বেড়ায়। এসেছে নতুন বছর। নতুন বছরে পার্বত্যবাসীর আশা, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের স্বার্থে এক হয়ে কাজ করবে। সবুজ পাহাড় থেকে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র, এমন প্রত্যাশা রাঙামাটিবাসীর।

আওয়ামী লীগ থেকে হেভিওয়েট ২ নেতার অব্যাহতি

রাঙামাটিতে ২০২২ সালের শুরুতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা লংগদু উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম এবং পাঁচ ইউনিয়নের নৌকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া ছয় নেতাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয় রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জেলা আওয়ামী লীগের এক জরুরি সভা থেকে এমন সিন্ধান্ত জানায় জেলা আওয়ামী লীগ। প্রায় এক বছর পার হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ নেতাদের এ অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার করেনি জেলা কমিটি।

ছাত্রলীগ নেতা হত্যা

জেলা শহরের হাসপাতাল এলাকায় ১৬ মার্চ রাতে ছাত্রলীগ নেতা জয় ত্রিপুরাকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার দু’দিন পর ১৮ মার্চ নিহতের বড় ভাই সাগর ত্রিপুরা বাদী হয়ে রাঙামাটি কোতয়ালী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করলেও খুনিরা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। ২২ মার্চ মঙ্গলবার সকালে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার পাইন্দং পাড়ায় মগ লিবারেশন পার্টির উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের তিনজন সশস্ত্র সদস্যকে হত্যা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র সদস্যরা। উভয় গ্রুপের সংঘর্ষে নিহতদের ছবিগুলো একাধিক সোর্স থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে এসে পৌঁছায়। কিন্তু ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে তা নিশ্চিত হতে গণমাধ্যম কর্মীদের মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত গলদঘর্ম হতে হয়েছে। ১২ মে রাতে রাঙামাটির বরকল উপজেলার সীমান্ত এলাকায় জেএসএস (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা লক্ষী চন্দ্র চাকমা (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে।

এপিবিএন ব্যাটালিন হচ্ছে পাহাড়ে

২৫ মে রাঙামাটিতে দু’দিনের সফরে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানখান কামাল। পুলিশের এপিবিএন ব্যাটালিয়ন দপ্তর উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনাদের কাছে আমরা ওয়াদা করছি, আমাদের পুলিশ বাহিনী আপনাদের পাশে থাকবে। আপনারা প্রতিবাদ করুন, প্রতিরোধ করুন। আপনারা যে যেখানে পারুন এই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আমাদের তথ্য দিন। আমরা অবশ্যই সকল সন্ত্রাসী এবং নামে-বেনামে যারা চাঁদাবাজি করছে, কিংবা রক্তপাত করছে তাদের আইনের মুখোমুখি করবো, এটাই আমাদের ওয়াদা। তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হবে এবং আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি পেতে হবে।

বিলাইছড়িতে কেএনএফ-জেএসএস সংঘর্ষে নিহত ৪

রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’র (কেএনএফ) হামলায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সশস্ত্র গ্রুপ জুম্মল্যান্ড লিবারেশন আর্মির (জেএলএ) ৪ সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে বলে দাবি করে কেএনএফ’র হেডকোয়াটার্স’র লেফট্যানেন্ট কর্নেল সলোমন। নিহতরা হলেন বিচাই চন্দ্র ত্রিপুরা (৫২), সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরা (২৩), বীর কুমার ত্রিপুরা (২১) ও ধনরাম ত্রিপুরা (১৬)। সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ তাদের নিজস্ব ফেইসবুক পেইজে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশ করে বলে, ২১ জুন সন্ধ্যায় বিলাইছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায় ও বড়তলী ইউনিয়নের জাইজাম পাড়ায় জেএলএ’র সৃষ্ট নতুন সশস্ত্র বেসমেন্ট ক্যাম্পে কেএনএফ’র স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স হেড-হান্টার টিম সফলভাবে হামলা চালায়। এতে জেএলএ’র তিন সশস্ত্র সদস্য ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পরে আরও একজন মারা যায়। তবে আহত জেএলএ’র অন্য সদস্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

জেএসএস-এমএলপি সংঘর্ষে নিহত ১

রাঙামাটির রাজস্থলীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সন্তু গ্রুপ ও মগ লিবারেশন আর্মির সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে জেএসএস (সন্তু) দলের সামরিক কমান্ডার লে. অভিষেক ওরফে সুজন চাকমা নিহত হয়েছে। ২৪ জুন দিবাগত মধ্যরাতে রাজস্থলী উপজেলা সদরের নিকটে ২নং গাইন্দ্যা ইউনিয়নের ওগারী পাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

জেএসএস-ইউপিডিএফ সংঘর্ষে হতাহত

রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলা ও খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা সীমান্ত এলাকায় মাইনি নদীর পাড়ে জেএসএসের গুলিতে বিনয় চাকমা (২৪) নামের ইউপিডিএফের এক সদস্য নিহত হয়। ১৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের উত্তর জারুলছড়ি দুলুবনিয়া এলাকায় পাহাড়ি আঞ্চলিক দুই সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর মধ্যে ভয়াবহ বন্দুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২৬ আগস্ট ভোর ৫টায় গোলাগুলি শুরু হয়ে আনুমানিক দুই ঘণ্টা এই বন্দুক যুদ্ধ চলে। এতে উভয় পক্ষই শত শত রাউন্ড গুলি বিনিময় করে। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে উভয় পক্ষের ৩ সদস্য নিহতের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে।

রাঙামাটির নানিয়ারচরে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসিত গ্রুপের সহকারী পরিচালক সুবাহু চাকমা ওরফে গিরি চাকমা (৫০) নিহত হয়েছে। তিনি সাবেক্ষ্যং ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড এগারইল্যা ছড়া এলাকার বাসিন্দা বিরাজ মোহন চাকমার ছেলে। ৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে নানিয়াচরের রাঙিপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত সুবাহু চাকমা নানিয়াচর উপজেলার এগারেল ছড়ার মৃত বিরাজ মোহন চাকমার ছেলে। স্থানীয়রা জানায়, গিরি চাকমা আগে ইউপিডিএফ (সংস্কার) দলের সদস্য ছিলেন।

জেএসএস সদস্য নিহত

রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও জেএসএস (মূল) দলের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জেএসএসের এক সন্ত্রাসী নিহত হয়। ২৮ জুলাই বেলা সাড়ে ১২টায় কাপ্তাইয়ের ববিতা টিলা নামক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জেএসএস সন্ত্রাসী নিখিল কুমার দাশ (৩৫) মৃদুল কুমার দাশের ছেলে। তিনি কাপ্তাই ৪নং ইউনিয়ন চৌধুরীছড়া নামক এলাকার বাসিন্দা।

ভূমি কমিশনের কার্যক্রম প্রতিরোধে আন্দোলন

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বৈঠক প্রতিরোধের লক্ষ্যে রাঙামাটিতে দু’দিনের হরতালের ডাক দেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। তবে কমিশন বৈঠক স্থগিত করলে হরতাল প্রত্যাহার করে নেয় সংগঠনটি।

পাহাড়ি সন্ত্রাসী কর্তৃক অটোরিকশা ভাঙচুর

১৮ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে পাহাড়ি সন্ত্রাসী কর্তৃক অটোরিকশা ভাঙচুরের ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করে অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চালক কল্যাণ সমিতি। তবে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঘটনাটির ক্ষতিপূরণ দিলে এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ^াস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে স্পিডবোটের সঙ্গে বালুবাহী বোটের ধাক্কায় দুজন নিখোঁজ হয়। পরবর্তীতে তাদের লাশ উদ্ধার করে উদ্ধারকারীরা। এ দুর্ঘটনায় আহত হয় আরো ৭ জন। ৪ নভেম্বর দুপুরে লংগদু উপজেলার কাট্টলীবিল বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিহতরা হলেন, বাঘাইছড়ি উপজেলার ক্যাংড়াছড়ি গ্রামের বাসিন্দা লিটন চাকমা (২৯) এবং বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের হাজাছড়া গ্রামের বাসিন্দা এলোমিনা চাকমা (২৭)।

জেএসএস সদস্য নিহত

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম নিউলংকর দাড়ি পাড়া গ্রামের মিড পয়েন্ট এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে সুখেন চাকমা (২০) নিহত হয়। এই ঘটনায় সজীব চাকমা (২২) নামে আরো এক যুবক পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। আহত সজীব চাকমাকে উদ্ধার করে গ্রামবাসী হাসপাতালে পাঠায়। ৩০ নভেম্বর সকাল ৯টার দিকে এই ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেন সাজেক থানা ওসি নুরুল আলম। আহত ও নিহত দুজনেই পেশায় মোটরসাইকেল চালক ও সম্পর্কে চাচাতো ভাই। তারা দুইজন পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সমর্থক বলে জানান স্থানীয়রা। এই ঘটনার জন্য পাহাড়ের আরেক আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)কে দায়ী করে জেএসএস (সন্তু) বাঘাইছড়ি উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ত্রিদিপ চাকমা।

ছাত্রলীগ নেতা নিখোঁজ

রাঙামাটি রাজস্থলী উপজেলায় মোহাম্মদ সালাউদ্দিন নামে এক যুবক নিখোঁজ হয়। ৪ ডিসেম্বর এ নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। নিখোঁজ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন উপজেলার ৩নং বাঙালহালিয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের শফিপুর শিবির এলাকার বাসিন্দা সাবেক মেম্বার মৃত মজিবুর রহমানের ছেলে এবং রাজস্থলী উপজেলা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক। ছাত্রলীগ নেতার নিখোঁজের প্রতিবাদে স্থানীয় লোকজন ২০ ও ২১ ডিসেম্বর তার উদ্ধারের দাবিতে হরতাল পালন করে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: রাঙামাটি, সালতামামি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন