বাঘগুজারা রাবার ড্যাম অকার্যকর হয়ে পড়ায় ৪০ হাজার একর জমির চাষাবাদ অনিশ্চিত

66

চকরিয়া প্রতিনিধি:

মাত্র ৫০ গজ দূরত্বে শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করায় দেশের বৃহত্তম কক্সবাজারের চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীর বাঘগুজারা পয়েন্টের রাবার ড্যামটি (বাঁধ-ব্যারাজ) অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বালু উত্তোলনের কারণে ড্যামের রাবারের তলদেশ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় ২৩৩ দশমিক ৫০ মিটার দীর্ঘ বৃহত্তম এই ড্যামের চার স্প্যানের এক পয়েন্টের ফুলানো রাবার দেবে গিয়ে  রবিবার ভোর থেকে আটকানো মিঠা পানি ভাটির দিকে নেমে যাচ্ছে। অপরদিকে ওই পয়েন্ট দিয়ে সামুদ্রিক জোয়ারের সময় নদীতে ঢুকে পড়ছে লবণাক্ত পানি। এই অবস্থায় চলতি শুষ্ক মৌসুমে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার প্রায় ৪০ হাজার একর জমির ইরি-বোরো চাষাবাদ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন অর্ধ লক্ষাধিক কৃষক।

প্রসঙ্গত, অক্টোবর মাসে বালু উত্তোলনের কারণে রাবার ড্যামটি হুমকির মুখে শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মাতামুহুরী নদীর বাঘগুজারা পয়েন্টে নির্মিত দেশের বৃহত্তম রাবার ড্যাম (বাঁধ, ব্যারাজ) হুমকিতে পড়েছে। ড্যামটির মাত্র ৫০ গজ দূরে শ্যালো মেশিন বসিয়ে নদীর তথা ড্যামের তলদেশ থেকে বালু তুলছে একটি চক্র। এর আগে ড্যামটির আশপাশ থেকে বালু তোলায় রাবারের জোড়া ছিঁড়ে নদীতে ঢুকে পড়েছিল লবণ পানি। এবারও তেমনটি হলে শুষ্ক মৌসুমে মিঠা পানি ধরে রাখা যাবে না। তাতে ৪০ হাজার একর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হবে। আর বর্ষাকালে ধসে যেতে পারে ড্যামসহ ওপরের সেতুটিও।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, বৃহত্তম এই রাবার ড্যামের চার স্প্যানের মধ্যে দক্ষিণাংশের দ্বিতীয় পয়েন্টের ফুলানো রাবার দেবে গেছে। এতে ধরে রাখা মিঠা পানি নেমে যাচ্ছে ভাটির দিকে। আবার জোয়ারের সময় দেদারছে নদীতে ঢুকে পড়ছে লবণাক্ত পানি।

এ সময় জানতে চাইলে রাবার ড্যামের তদারক আবদুর রহিম বলেন, ‘প্রায় একমাস আগে ড্যামের চার স্প্যানের রাবার ফুলিয়ে মিঠাপানি আটকানো শুরু হয়। কিন্তু সোমবার ভোর থেকে চার স্প্যানের মধ্যে এক পয়েন্টের ফুলানো রাবার দেবে গিয়ে ধরে রাখা মিঠা পানি নেমে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিক বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাহেদুল ইসলামকে অবহিত করি।’

প্রশ্নোত্তরে ড্যাম তদারক আবদুর রহিম বলেন, ‘ড্যামটির একেবারে কাছ থেকে শ্যালো মেশিন বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন করেছেন একটি প্রভাবশালী চক্র। এ কারণে ড্যামের রাবারের তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে ফুলানো রাবার দেবে যায়। এতে ড্যামটির এই সর্বনাশ ঘটেছে।’

পাউবো সূত্র জানায়, শ্যালো মেশিনে দেদারছে বালু উত্তোলনের কারণে চলতি বছরের মার্চের প্রথমদিকে ড্যামের তলানির বেইজের পাইলিংয়ের গোড়া থেকে মাটি সরে যায়। এ কারণে ওই সময় চার স্প্যানের মধ্যে দ্বিতীয় স্প্যানের রাবারের জোড়া ছিঁড়ে নদীতে লবণ পানি ঢুকে পড়ে। এরপর পাউবোর প্রকৌশলীল কয়েক দফা তৎপরতায় ছিঁড়ে যাওয়া রাবার জোড়া লাগানো হয়।

চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এ টি এম জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জিয়া বলেন, ‘ড্যামটি নির্মাণের সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছিল। এ কারণে নির্মাণের পর বারবার বিপর্যয় ঘটে। এর ওপর একেবারে কাছে শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু তোলার সময় ড্যামটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ছিল। বালু উত্তোলনের কারণে শেষপর্যন্ত ড্যামটি অকার্যকর হয়ে পড়ায় মিঠাপানির জন্য দুই উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের অন্তত ৪০ হাজার একর জমির ইরি-বোরো চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।’

পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ চৌধুরী রাজু বলেন, ‘বাঘগুজারা রাবার ড্যামের ধরে রাখা মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানি ব্যবহার করে পেকুয়ার সাতটি ইউনিয়নের কৃষকরা শুষ্ক মৌসুমে ইরি-বোরো চাষাবাদ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়। এই অবস্থায় ড্যামটি অকার্যকর হয়ে পড়ায় কৃষকের মাথায় হাত উঠেছে। তাই অতিদ্রুত ড্যামটি সচলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর পরই আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। দ্রুতসময়ের মধ্যে ড্যামটি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি।’

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ‘সঠিক কি কারণে ড্যামটি বার বার অকার্যকর হচ্ছে তা নির্ণয় করা হবে। এজন্য জেলার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সরজমিন ড্যামটি দেখতে যাচ্ছেন। অতিদ্রুত সময়ে ড্যামটি সচল করতে আমরা তৎপর রয়েছি।’

পাউবো জানায়, প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর পালাকাটা-রামপুর ও বাঘগুজারা পয়েন্টে দুটি রাবার ড্যামের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। পারিশা অ্যান্ড কম্পানি এবং ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ড্যাম দুটির নির্মাণকাজ শেষ করলে ২০১২ সালে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত বালু উত্তোলনসহ নানা কারণে বেশ কয়েকবার অকার্যকর হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন