বাঙালী ও ইসলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও খ্রিস্টীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে নীরব পার্বত্য আঞ্চলিক দল ও সংগঠনগুলো

bangladesh-christian-girls-resized

পাহাড়ে খ্রীস্টান সম্প্রসারণবাদ মিশন-৩
 
 এম.এ.হোসাইন , খাগড়াছড়ি ॥
শুধু খাগড়াছড়ি নয়, রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন দুর্গম উপজেলাতেও নিরবে চলেছে খ্রীস্টান মিশনারীর কার্যক্রম। এ জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ২৫ শতাংশই খ্রীস্টান ধর্মের অনুসারী হয়েছেন পর্যায়ক্রমে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নেতৃস্থানীয়রা রাজনৈতিক সভা সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও খ্রীস্টান সম্প্রসারণবাদের বিষয়ে তারা রহস্যজনকভাবে নীরব।

খাগড়াছড়ি জেলায় খ্রীস্টান সম্প্রসারণবাদের কাজ শুরু হয় ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে। তৎকালীন সময়ে ফেনী শহরের মহিপালে অবস্থিত খ্রীস্টান মিশনারীর পরিচালক মি: বার্কলির উদ্যেগে খাগড়াছড়িতে খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম দফায় খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রণবিক্রম ত্রিপুরার (বর্তমানে আওয়ামী নেতা) মাধ্যমে ত্রিপুরাদের শিক্ষিত শ্রেণীর একটি অংশকে ফেনীতে তাদের নির্ধারিত স্থানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। নির্ধারিত সময়ে ১৩টি মোটর সাইকেলযোগে ২৬ জন শিক্ষিত ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি থেকে ফেনীতে গিয়ে খ্রীস্টান ধর্মের একটি প্রচার অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এদের অনেকেই খ্রীস্টান ধর্মের প্রতি নিজেদের দুর্বলতার কথা প্রকাশ করে নিজ এলাকায় এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সমাধানে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হয়। চুক্তির আগে ও পরে বিভিন্ন সংঘাতের কারণকে অজুহাত হিসেবে তুলে ধরে উপজাতীয়দের স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা সামাজিক নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে উদ্ভুদ্ব করতে থাকে সাধারণ উপজাতীয়দের। বলা হয় খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহন করলে কোন রকম অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হতে হবেনা। কারণ খ্রীস্টানদের উপর কিছু করলে তার পরিনতি কঠিন। এবং একপর্যায়ে খাগড়াছড়িতে খ্রীস্টান ধর্মের প্রসার লাভ করে প্রত্যাশিতভাবে।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, খাগড়াছড়িতে খ্রীস্টান ধর্মের অনুসারীদের পরিমান এখন ২৫ হাজারের উপরে। অথচ এ জেলায় গ্রাম ও পাড়া মহল্লায় তাদের ধর্মীয় উপাসনালয় রয়েছে তিন শতাধিকের উপরে। খ্রীস্টানধর্মীয় আচার আচরণ পালনের সুবাদে অনেক পরিবর্তন এসেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পোশাক আশাক, সামাজিক উৎসব, ধর্মীয় আচার আচরণ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং জাতিগত বৈশিষ্টে। হারিয়ে যাচ্ছে ওদের স্বকীয় স্বত্ত্বার ঐতিহ্যবাহি বর্ণিল সংস্কৃতি।

খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউটের পরিচালক সুসময় চাকমা বলেন, দরিদ্র ও হত দরিদ্র উপজাতীয়রা অর্থের লোভে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহন করতে প্রলুব্ধ করানো হচ্ছে। আবার সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলে খ্রীস্টানধর্ম প্রচারকরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে উদ্ভুদ্ব করছে, তবে এতে কারো মদদ আছে বলে আমার জানা নেই। তবে যেভাবেই হোক, এটি নিজস্ব সংস্কৃতি বিলুপ্তির জন্য মরণঘাতক। আমরা এটি আশা করিনা।

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জীবন জীবিকা আর ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল সামাজিক সাংস্কৃতিক বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিরাও খ্রীস্টান সম্প্রসারণবাদের বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। ধর্মান্তরের কারণে নিজস্ব সংস্কৃতি বিলুপ্তির বিষয়ে অভ দা রেকর্ডে তারা খোলামেলা অনেক কথা বললেও এ প্রতিবেদককে বারবার অনুরোধ করেছেন তাদের পরিচয় গোপন রাখতে। এর মধ্যে আছেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা গবেষক, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু নিয়ে পরিচিত বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দরাও।

আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সক্রিয় ও আন্দোলনরত। কিন্তু খ্রিস্টিয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে রহস্যময় নীরব। অর্থ, সমর্থন ও সুবিধা দিয়ে তাদের ,মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে। এখানকার যেসকল এনজিও, সংস্থা ও ব্যাক্তিবর্গ উপজাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করছে, ইসলামী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে তারা প্রবলভাবে সোচ্চার; কিন্তু খ্রিস্টীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে তারা শুধু নীরবই নয় বরং সহাযক ভূমিকা পালন করছে।

মুসলিম বন্ধু ও সহপাঠিদের সাথে চলাফেরা ও কথাবার্তা বললে যারা উপজাতিয় মেয়েদের নির্যাতন করতে, এসিড মারতে, আঘাত করে পঙ্গু করে দিতে সদা খড়গহস্ত, মুসলিম ছেলেদের বিয়ে করলে উপজাতীয় মেয়েদের গণধর্ষণের মাধ্যমে হত্যা করতে যারা সদা প্রস্তুত; খ্রিস্টান ছেলেদের সাথে ওঠাবসা করলে, বন্ধুত্ব করলে এমনকি বিয়ে করলে উপজাতীয় মেয়েদের বেলায় তারা কেবলই স্বাক্ষী গোপাল। খ্রিস্টীয় সম্প্রসারণবাদীরা ‘আদিবাসী’ আন্দোলনের, পুরোহিত রাজা দেবাশীষ রায়ের কাছেই সবচেয়ে বেশী আতিথ্য ও পৌরহিত্য পেয়ে থাকেন। দলে দলে বৌদ্ধরা খ্রিস্টান হলেও একইভাবে নীরব বৌদ্ধ ধর্মগুরু ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোও। তারাও চোখে কেবল প্রতিপক্ষ হিসাবে ইসলামকেই দেখতে পায়।

শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি খ্রীস্টান সম্প্রসারণবাদের বিষয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে তাদের নিজস্ব মতামত নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনিন্দ্রলাল ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউটের পরিচালক সুসময় চাকমা,ও খ্রীস্টান মিশনারীতে প্রশিক্ষণরত শিক্ষার্থী রমেশ্বর ত্রিপুরা।

খাগড়াছড়ি শহরের অদুরে নিউজিল্যান্ড সড়কের পাশে তেতুলতলা এলাকায় পাঁচ একর জায়গার উপর নির্মিত রোমাণ ক্যাথলিক মিশনারীর ইলেকট্রিক প্রশিক্ষণ ট্রেডে প্রশিক্ষণরত বান্দরবানের ছেলে রমেশ্বর ত্রিপুরা বলেন, আমি হয়তো নিজের প্রয়োজনে কিংবা স্বার্থের কারনে এখানে এসে ধর্মান্তরিত হয়েছি। আমি কতটুকু পালন করি আর না করি এটি বড় কিছু নয়, আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিন্তু এর অনুসারী হচ্ছে নির্দিধায়, কারণ সমাজে তাদের পরিচয় একটি বড় ব্যপার। রমেশ্বর নিজেই অনুমান করেছে তার প্রজন্মকে নিয়ে। অবশ্যই তারা সেই ধর্মের অনুসারী হবে আমি যেই ধর্ম গ্রহন করেছি। খ্রীষ্ঠানধর্মগ্রহনকারী একজন  রমেশ্বরের বক্তব্যে এভাবেই ফুটে উঠেছে খ্রীষ্ঠান সম্প্রসারণবাদের নীরব কথা। (শেষ)

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন