মিয়ানমারের চলমান সংঘাত ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

fec-image

মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা বন্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বরং দিন দিন তা আরও সংগঠিত ও জোরদার হচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা বিরোধী জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) সভাপতি দুওয়া লাশি লা জানায় যে, জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত আধাসামরিক বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। পিডিএফ এখন স্বয়ংক্রিয় রাইফেলে সজ্জিত কৌশলগত এবং সুসংগঠিত রেজিমেন্ট এবং ব্যাটালিয়ন গঠন করেছে এবং সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সফলতার সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এনইউজি প্রধান জানায় যে, জান্তা বিরোধী বাহিনী এখন দেশটির সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করছে। পিডিএফ যোদ্ধারা সামরিক জান্তা সৈন্যদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করতে অ্যাটাক ড্রোনও ব্যবহার করছে। এনইউজি’র প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মং মং সুই জানায় যে, পিডিএফ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতে নতুন ফ্রন্ট খুলে সাগাইং এবং ম্যাগওয়ে অঞ্চলের পাশাপাশি চিন, কায়াহ এবং কায়িন রাজ্যের নতুন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে। গত দুই বছরে চলমান যুদ্ধে পিডিএফ গ্রুপগুলো জান্তা সৈন্যদের হত্যাসহ ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছে।

৩১ জুলাই জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জান্তা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং উল্লেখ করেন যে সাগাইং, ম্যাগওয়ে, বাগো এবং তানিনথারি অঞ্চলের পাশাপাশি কায়িন, কায়াহ, চিন এবং মোন রাজ্যে সেনাবাহিনীর সাথে পিডিএফের লড়াই চলছে। রাজ্যগুলো যুদ্ধ, মাইন হামলা ও অগ্নিসংযোগে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপক সংঘাত মোকাবেলায় ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ গ্রহণের জন্য জান্তা জরুরি অবস্থা আরও ছয় মাসের জন্য বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকদের মতে মিয়ানমারে প্রায় প্রতিটি সংঘর্ষ বা যুদ্ধে বিপ্লবী বাহিনীর তুলনায় জান্তা বেশি হতাহতের শিকার হয়েছে। এ অবস্থায় স্থল যুদ্ধের পাশাপাশি তাদেরকে আরও বেশি বিমান শক্তি এবং বিমান ব্যবহার করতে হবে।

জান্তা বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর থেকে জানা যায় যে, চতুর্থবারের মতো জরুরি অবস্থা বাড়ানোর পর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, জাতিগত সেনাবাহিনী ও পিডিএফের কাছ থেকে তাদের দখলে থাকা এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা পুনরায় শুরু করায় দেশটির ৮টি রাজ্য ও অঞ্চলে লড়াই তীব্রতর হয়েছে। তারা শান, কাচিন, কায়িন এবং মোন রাজ্য এবং সাগাইং, বাগো, ম্যাগওয়ে এবং তানিনথারি অঞ্চলে লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়িয়েছে। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) কর্মকর্তারা জানিয়েছে যে কায়িন ও মোন রাজ্য এবং বাগো ও তানিনথারি অঞ্চলে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সৈন্যদের তীব্র লড়াই চলছে। জান্তা সৈন্যরা কেএনইউ নিয়ন্ত্রিত সাতটি এলাকায় হামলা চালাচ্ছে এবং সেখানে প্রায় ১০৯টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে। কাচিনের জেড খনি অঞ্চলে লড়াই তীব্রতর হয়েছে এবং জেড খনি এলাকায় জান্তা বিমান হামলা চালিয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ইউএনওসিএইচএ) প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে চলমান যুদ্ধের কারণে ১৬ লাখেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।

২০২১ সালে সামরিক শাসন জারির পর পশ্চিমাদেশগুলো মিয়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মিয়ানমার সামরিক সরকার চীন, রাশিয়া ও ভারত সফর করে দেশগুলো থেকে সমরাস্ত্র ও সরঞ্জাম কিনেছে। বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসার ওপর নিয়মিত গবেষণা পরিচালনা করে সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি)। সিপরির ২০২৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত ট্রেন্ডস ইন ইন্টারন্যাশনাল আর্মস ট্রান্সফার ২০২২ প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায় যে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল সময়কালে মিয়ানমার যত অস্ত্র কিনেছে, তার ৪২ শতাংশ রাশিয়া, ২৯ শতাংশ চীন এবং ১৪ শতাংশ ভারত থেকে এসেছে। এই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার কাছ থেকে প্রথম ধাপে দুটি সুখোই যুদ্ধবিমান পেয়েছে মিয়ানমার, পরবর্তীতে আরও চারটি সুখোই যুদ্ধবিমান মিয়ানমারের বহরে যোগ হবে।মিয়ানমারের জান্তা সরকার প্রধান মিন অং হ্লাইং ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সফরের সময় রাশিয়ার কাছ থেকে ৬টি সুখোই এসইউ-৩০এসএমই যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছিল। রাশিয়ার তৈরি সুখোই এসইউ-৩০ এসএমই যুদ্ধবিমানগুলো আকাশ থেকে ভূমিতে, আকাশ থেকে আকাশে আক্রমণের ক্ষেত্রে কার্যকর। এই বিমান চলমান সহিংসতা মোকাবেলায় জান্তার সক্ষমতা বাড়াবে।

মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশও মিয়ানমারের সাথে আলোচনা, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক চলমান রেখেছে। মিয়ানমারে বাংলাদেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ড. মো. মনোয়ার হোসেন ৬ সেপ্টেম্বর স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল চেয়ারম্যান জেনারেল হ্লাইংয়ের কাছে আনুষ্ঠানিক পরিচয়পত্র পেশ করেন। পরিচয়পত্র গ্রহণ করে চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূতের সাথে আলোচনাকালে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। চলমান প্রেক্ষাপটে এটা একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত। আলোচনাকালে জেনারেল হ্লাইং বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও বৃদ্ধির বিষয়ে আশা প্রকাশ করেন এবং উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়, যেমন– রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, বাণিজ্য সম্পর্ক, আকাশ, স্থল ও নৌপথে যোগাযোগ বৃদ্ধি, মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান রোধসহ প্রথাগত এবং অপ্রথাগত নিরাপত্তা সহযোগিতা, সামরিক সহযোগিতা ও জনযোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়ে মতবিনিময় করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দু’দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে তাঁর সহযোগিতা চান।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা গত ছয় বছর ধরে এদেশে অবস্থান করছে। চীনের উদ্যোগে মিয়ানমার সরকারের নেয়া একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের একটি ছোট দলকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা কামনা করে। প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবিতে ২৪ আগস্ট গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। ‘সর্বস্তরের কক্সবাজারবাসী’ ব্যানারে সমাবেশে স্থানীয় নেতারা বলেন যে, বছরের পর বছর রোহিঙ্গারা অবস্থান করায় সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। ক্যাম্পগুলোতে নিয়মিত খুনখারাবি হচ্ছে, মাদক ও মানব পাচারের নিরাপদ ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। তারা এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চায়। বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের পাইলট প্রত্যাবাসনে বাধা না দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গারাও তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে চায়, সেখানে তাদের ঘরবাড়ি না থাকলে ও অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে সেখানে একটি দল গেলে, কী কী ধরনের সমস্যা রয়েছে, তা জানা যাবে এবং তা পরবর্তীতে নিয়মিত প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের পাইলট প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমার। ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফেরত নেয়ার বিষয়ে রাজি হয়েছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। পাইলট প্রত্যাবাসন সফল করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সামনের দিনগুলোতে একাধিক বৈঠক হবে। বৈঠকে যোগ দিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল মিয়ানমার গিয়েছিল। এর পর মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করতে কক্সবাজার আসবে। পাইলট প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়েছে। তাদের সুরক্ষা, মর্যাদার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি রোহিঙ্গারা যাতে প্রত্যাবাসনের সময়ে পরিবার থেকে আলাদা না হয় এবং একই এলাকার রোহিঙ্গারা যাতে একসঙ্গে যেতে পারে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে । এই প্রত্যাবাসন শুরুর আগে মিয়ানমার থেকে প্রতিনিধি দল এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করবে। এই প্রত্যাবাসন বিষয়ে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো জানিয়েছে যে, মিয়ানমারে গণতন্ত্র নেই এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য এখনও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে চলমান সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সামনের দিন গুলোতে আরও বেগবান হবে এবং উভয় পক্ষই তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে চলছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পশ্চিমা দেশ, আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো এবং বিশ্বসম্প্রদায়ও মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আসিয়ান তাদের উদ্যোগ অব্যাহত রাখলেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। অন্য দিকে বাংলাদেশ এই বোঝা অনির্দিষ্টকাল ধরে বয়ে যেতে পারবে না। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের পরিমাণ প্রতিদিনই কমছে এবং এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে।

রাখাইন প্রদেশ মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা এবং এখানকার সমস্যার প্রকৃতিও ভিন্নতর। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনের বাসিন্দা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং রোহিঙ্গা ও অন্যান্য বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়কে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে ও টেকসইভাবে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিস্থিতি তৈরি করতে এনইউজি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর পাশাপাশি মিয়ানমারের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জেনারেল মিং অং হ্লাইংয়ের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা বিষয়টির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ গত ছয় বছর ধরে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিকভাবে একটি কার্যকর সমাধানের চেষ্টা করেছে এবং এই উদ্যোগটি কার্যকর করতে আগ্রহী। বর্তমানে রাখাইন পরিস্থিতি মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলগুলো থেকে স্থিতিশীল রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নেয়া পাইলট প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে এর ফলাফল ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে আগামীতে তা চলমান রাখতে পারলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের উদ্যোগ আশার আলো দেখবে।

লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন