মিয়ানমার সীমান্তে ব্যাপক সংঘর্ষ: পালিয়ে এপারে আশ্রয় নিয়েছে বিজিপি সদস্যরা

fec-image

মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে পাঁচ বাংলাদেশি আহত হয়েছে। এদিকে সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেকিবনিয়া ক্যাম্পে ব্যাপক গোলাগুলি ও বোমা বর্ষণ চলমান রয়েছে। বিদ্রোহী গ্রুপ আরকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর মধ্যে এ সংঘর্ষ হচ্ছে। শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তে থেমে থেমে গুলি ও বোমাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত জনপদ পরিণত হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে।

মিয়ানমারের সংঘাতের গুলি, মর্টার শেল এসে পড়েছে সীমান্তের এপারেও। এতে পাঁচ বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, পুঁড়েছে বসত ঘর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সীমান্তবর্তী পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা। সব মিলে চরম আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা।

এদিকে সীমান্তের ওপার থেকে বেশ কয়েকটি গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তুমব্রু কোনার পাড়া, মাঝের পাড়া ও বাজার পাড়ায়। আতঙ্কে ঘর ছেড়েছে এই ৩ গ্রামের মানুষ। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ৫ জন। কোনার পাড়ার কয়েকটি বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে আহতরা হলেন, কোনার পাড়ার বাসিন্দা প্রবীন্দ্র ধর (৫০), রহমা বেগম (৪০), টিটু (৩০) এবং আমির হোসেনের ছেলে শামশুল আলম, আর একজনের নাম পরিচয় জানা যায়নি। তাদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বিদ্রোহী গ্রুপের ব্যাপক গুলাগুলির কারণে টিকতে না পেরে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপির ৫৮ জনের মতো সদস্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছে। সীমান্তপথে আরো ৩০ জনেরও বেশি বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে ঢোকার জন্য অবস্থান নিয়েছে বলে সীমান্তের স্থানীয়রা বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

শনিবার রাত ৩টা থেকে ব্যাপক গুলি বর্ষণের পাশাপাশি, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও জান্তা বাহিনী সামরিক হেলিকপ্টার থেকে বোমা মারছে। রবিবার দুপুর ১২ টার দিকে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর একটি সামরিক হেলিকপ্টার সীমান্তের ওপারে চক্র দিতে দেখা যায়। হেলিকপ্টার থেকে বিদ্রোহীদের লক্ষ করে গুলি, মর্টার শেল ও বোমাবর্ষণ করা হয়। পাল্টা জবাবে বিদ্রোহী গোষ্ঠী (আরকান আর্মির) সদস্যরা ভারি ভারি অস্ত্র ব্যবহার করেন।

একইদিন সন্ধ্যার দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি যুদ্ধ বিমান থেকে ফেলা হয় বোমা। এতে সীমান্তের বাজার ঘাট বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্পের চতুর্পাশে বিদ্রোহী গ্রুপ আরকান আর্মি ঘিরে রেখেছে এবং বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট বিদ্রোহী গ্রুপ আরকান আর্মি দখলে নিয়েছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, মিয়ানমারের বিজিপির কিছু সদস্য তুমব্রু সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সীমান্তে লাগুয়া স্কুলগুলো আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবিও নিরাপত্তা বাড়িয়েছে সীমান্তে। নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, সীমান্তে যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সীমান্তের দিকে নজর রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমার বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে সেদেশের জান্তা সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। এ সংঘর্ষের জের ধরে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তেও উত্তেজনা চলছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে মিয়ানমারের তুমব্রু ক্যাম্পটি।

এদিকে বর্তমানে সীমান্তজুড়ে টান টান উত্তেজনা বিরাজমান। সীমান্তজুড়ে চলছে আতঙ্ক। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে আত্বীয় স্বজনের বাড়িতে। এই রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত হেলিকপ্টার ও সামারিক বিমান থেকে গোলা ও বোমাবর্ষণ চলছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য দীল মোহাম্মদ জানান, ৩ গ্রামের হাজারো মানুষ গত রাত থেকে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। গরু, ছাগল, হাস, মুরগী ওই অবস্থায় রেখে ঘরবাড়ি ছেড়েছে সবাই। মালামাল নেওয়ারও সুযোগ হয়নি।

বিজিবির কক্সবাজারস্থ ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল আশরোকি মিয়ানমারের সীমান্তরাক্ষী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য পালিয়ে আসার কথা জানালেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের সংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেননি।

তিনি বলেন, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সঙ্গে রাত থেকে তুমুল যুদ্ধের মধ্যে কয়েকজন বিজিপি সদস্য প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করেছে। এদের বিজিবির ঘুমধুম সীমান্ত বিওপিতে রাখা হয়েছে। বিজিপি সদস্যদের অস্ত্র ও গুলি বিজিবির কাছে জমা রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গুলিবিদ্ধ ৫ বাংলাদেশি, পুড়েছে বসত ঘর:

মিয়ানমারের সংঘাতে ছোড়া গুলিতে বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় ৫ বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। তার মধ্যে একজনের তার ডান হাতে গুলি লেগেছে। রবিবার সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ প্রবীর চন্দ্র ধর ঘুমধুম ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা। তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গুলি ও মর্টারশেল পড়ে সীমান্তের একটি বাড়িতে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। তবে স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

এ বিষয়ে বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, “একজন আহত হয়েছে বলে শুনেছি। বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।” তবে “ঘুমধুমের পরিবেশ থমথমে, আতঙ্কে লোকজনের চলাচল সীমিত হয়েছে।”

ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক (আইসি) মাহাফুজ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বলেন, “গত শনিবার দুপরে ও রবিবার রাত তিনটা থেকে গোলাগুলি চলেছে ওপারে। গোলাগুলির শব্দে মানুষের মনে ভয়-আতঙ্ক তো হবেই। তবে যেকোনও পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের নিরাপত্তা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি।”

আবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা:

মিয়ানমারে সংঘাতের জেরে সীমান্তঘেঁষা এলাকার পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা আবারও বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ত্রিরতন চাকমা জানান, শনিবার রাত থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের ভেতরের গোলাগুলির কারণে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার বাঁইশফাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম কুল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তর ঘুমধুম নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বেতবনিয়া মিশকাতুন্নবী (র:) দাখিল মাদ্রাসা রবিবার একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান, বান্দরবান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ফরিদুল আলম হোসাইনি।

মিয়ানমারের সংঘাতের কারণে এর আগে ২৯ জানুয়ারি একদিনের জন্য বন্ধ ছিল পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি দাখিল মাদ্রাসা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বিজিপি, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন