শান্তি চুক্তির ১৯ বছরেও পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হয়নি

cht-1-300x224

নিজস্ব প্রতিবেদক :
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে তৎকালীন আওয়ামীলীগ ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) মধ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর হয়েছিল। সশস্ত্র বাহিনীর (শান্তি বাহিনী) গেরিলা নেতা জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান সন্তু লারমা এবং সরকারের পক্ষে তৎকালীন সংসদের চীফ হুইফ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। সরকার ও জেএসএস এ চুক্তিকে শান্তি চুক্তি নামে অবহিত করলেও তিন পার্বত্য জেলার বাঙ্গালিদের অধিকার আদায়ের নেতারা চুক্তির বিভিন্ন ধারার কারণে তাদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে এ অভিযোগে তারা এটিকে পার্বত্য কালোচুক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে জেএসএস এবং শান্তি চুক্তি বাতিল ও সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন করছে বাঙ্গালীদের পাঁচটি সংগঠন। অন্যদিকে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের আরেকটি সংগঠন ইউপিডিএফ, আর তারা পূর্ণাঙ্গ শায়ত্বশাসনের দাবিতে শান্তি চুক্তিকে প্রত্যাখান করেছে। এনিয়ে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র বন্দুক যুদ্ধে গত একবছরে অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির দীর্ঘ ১৯ বছর পার হলেও পাহাড়ে শান্তি আসেনি। শসস্ত্র শান্তি বাহিনীর সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করলেও পার্বত্যাঞ্চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি এখনো থামেনি। সাধারণ বাঙালি ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠী শান্তি চুক্তির সুফল না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে বান্দরবানে বাঙ্গালীদের সংগঠন নাগরিক পরিষদের সভাপতি আতিকুর রহমানকে একটি মামলায় জেল হাজতে থাকায় অন্য বাঙ্গালী সংগঠনের নেতারা মিডিয়ার সামনে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না বলে তারা জানিয়েছেন।

পাল্টাপাল্টি আন্দোলন আর সংঘাতে উত্তাল রয়েছে পাহাড়ী জনপথ। এ নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছেন পার্বত্য অঞ্চলের নাগরিকরা। পাহাড়ী-বাঙ্গালী দু’পক্ষের দ্বন্দের সুযোগে পাহড়ে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করে চলেছে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। চাঁদাবাজি আর অপহরণ পার্বত্যবাসীর জীবনে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তি চুক্তি সম্পাদনকারী আওয়ামীলীগ সরকার ৯০ ভাগ চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করলেও জনসংহতি সমিতি তা অস্বীকার করেন। তারা এটিকে সময় ক্ষেপণ বা তালবাহানা হিসেবে দেখছে। ফলে পার্বত্যাঞ্চলে বাড়ছে ভাতৃঘাতী সংঘাত। থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি আর রক্তপাত।

সরকার দাবি করছে শান্তি চুক্তি ৭২টি দাবীর মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়ন হয়েছে। এ চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে সংশোধন আকারে বিল পাশ হয়েছে। তারপরও ভূমির সমস্যার সমাধান কতটুকু হবে এ নিয়েও মতভেদ রয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের নাগরিকদের।

বান্দরবানে আওয়ামীলীগ নেতা মংপু অপহরণ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে দুটো সংগঠন আওয়ামীলীগ এবং জেএসএস। জেএসএস’র কয়েক ডজন নেতা বিভিন্ন মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে আত্মগোপনে রয়েছে। পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন ও অস্ত্রের ঝনঝনানি’কে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছে আওয়ামীলীগ।

গত দুদিন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন, সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে বক্তব্য প্রদানকালে পার্বত্যাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি এখনো থামেনি বলে মন্তব্য করেছেন। অবৈধ অস্ত্রধারীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলে চাকরির ব্যবস্থা করার ঘোষণাও দেন এবং পার্বত্যাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করেছেন।

বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি একে এম জাহাঙ্গীর বলেন, সরকার শান্তি চুক্তির ৯০ ভাগ বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় গুম চাঁদাবাজি হত্যা এসব কর্মকান্ড এখনো বন্ধ হয়নি। তিনি বলেন সরকার কথা রেখেছে কিন্তু জেএসএস তাদের কথা রাখেনি তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ছেড়ে সঠিক পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান।

অন্যদিকে জেএসএস এর বান্দরবান জেলার সহ-সভাপতি রুমা উপজেলার চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং মার্মা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে মিথ্যা মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। এ সময় তিনি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।অন্যথায় ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগের সাথে জেএসএস এর সম্পর্ক নষ্ট হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন।

অপর দিকে পার্বত্য এলাকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান, পাহাড়ের নেতারা। রাজনৈতিক সহিংসতা মামলা হামলার কারণে র্পাবত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ সমস্যাগুলো সমাধানে বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বান্দরবান জেলার সভানেত্রী ড. নাই প্রু নেলী জানান, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক। চুক্তির বেশিরভাগ ধারা ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে এখনো শান্তি ফিরে আসেনি। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

জেএসএস নেতা অংশৈ মং মার্মা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার ধীর গতিতে চলছে। এক পক্ষ চুক্তি বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে নানা তালবাহানা করছে। তিনি অবিলম্বে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন