সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬ ভাইয়ের পরিবার পাচ্ছেন জমিসহ ৮টি ঘর

fec-image

দেশজুড়ে আলোচিত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় পিকআপ চাপায় নিহত ছয় ভাইয়ের পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে জমিসহ সেমিপাঁকা আটটি ঘর। উপজেলা প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি মতে জমি-যাচাই করে নিহতদের পরিবারকে স্থায়ী বাসযোগ্য হিসেবে থাকার জন্য মুজিববর্ষ উপলক্ষে এসব ঘর নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। খুব দ্রুত গতিতে চলছে ওইসব ঘর নির্মাণ কাজ।

গত ২২মার্চ নিহতদের পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক ভাবে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান। নির্মাণাধীন ঘরে যাতে কোন ধরণের ত্রুটিবিচ্যুতি না ঘটে সেজন্য ইউএনও রীতিমত নিহতের পরিবারের এসব ঘরের নির্মাণ কাজ দেখভালো করে আসছেন।

জানাগেছে, উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট হাসিনাপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুরেশ চন্দ্র সুশীল সড়ক দুর্ঘটনা ট্র্যাজেডির ১০দিন পূর্বে মারা যান। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা ক্ষৌর কর্ম সম্পন্ন করতে মালুমঘাট হাসিনাপাড়া থেকে কক্সবাজার মহাসড়কের পূর্ব পাশে শশ্মানে যান। বাবা সুরেশ চন্দ্র শীলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার মালুমঘাট স্টেশনের অদূরে নার্সারি এলাকায় দ্রুতগতির পিকআপ ভ্যানচাপায় অনুপম শীল (৪৬), নিরুপম শীল (৪০), দীপক শীল (৩৫), চম্পক শীল (৩০) ও স্মরণ শীল (২৯) নিহত হন। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহতের ভাই রক্তিম শীল মারা যান। ঘটনার ১০ দিন আগে তাদের বাবা সুরেশ চন্দ্র শীলের মৃত্যু হয়। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা ৯ ভাইবোন বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন। মালুমঘাট এলাকায় একটি মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে একসঙ্গে ৯ ভাইবোন (৭ ভাই ও ২ বোন) হেঁটে বাড়িতে আসার জন্য সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

এ সময় পিকআপের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই একসঙ্গে চারজনের মৃত্যু হয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক ভাই। ঘটনায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান সুরেশ চন্দ্র শীলের মেয়ে মুন্নী শীল। আহত হন সুরেশ চন্দ্রের আরও দুই ছেলে ও এক মেয়ে। নিহতদের বোন হীরা শীল মালুমঘাট খ্রিস্টান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তবে, সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকে অদ্যবদি পুরো এলাকার বহু মানুষ তাদের রীতিমত শান্তনা দিতে ভিড করেছেন শোকাস্ত শীল পরিবারের বাড়িতে। নিহতদের গর্ভধারিণী মা মানু বালা শীল নাড়ি ছেড়া বুকের ধন হারিয়ে এখনো শোকে পাথর। নিহতদের স্ত্রী-সন্তানেরা এখনো বাকরুদ্ধ। দুর্ঘটনার কথা জিজ্ঞাস করলেই তাদের কান্না থামে না।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মৃত সুরেশ চন্দ্র শীলের বাড়িতে প্রবেশ করলে নিহত ৬ সহোদর তার স্বজনদের আহাজারি চোখে পড়ে। যেন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের ঘটনা। নিহতদের স্ত্রী ও সন্তান, কেউ বা তাদের আত্মীয় এখনো বিলাপ করে। স্বামী-সন্তান হারিয়ে সুরেশ চন্দ্র শীলের স্ত্রী মানু বালা শীল কারো সাথে তেমন কোনো কথা বলে না। তার চোখে পানি নেই। তিনি এতটাই শোকাহত যে কান্না করতেও যেন পারছেন না। পুরো পরিবার যেন শোকের মাতম। কর্মক্ষম সদস্যদের হারিয়ে চোখে অন্ধকার পরিবারগুলো। এছাড়াও নিহত ৬ সহোদরের ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা’র ছবি দেখে দেখে এখনো ঢুকরে ঢুকরে কাঁদে। এদিকে, ঘটনার পরথেকে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশ এবং বিশিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ, সামাজিক সংগঠন ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের লোকজন আর্থিক সহায়তা নিয়ে তাদের সামর্থ্যানুযায়ী পাশে দাঁড়িয়েছে।

নিহত ৬ পরিবার পেল প্রধানমন্ত্রীর ৩৫ লাখ টাকার অনুদান । সড়ক দুর্ঘটনায় পিকআপ গাড়ির চাপায় নিহত ৬ ভাইয়ের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ৩৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার অনুদান গত ১২ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দেয়া হয়। কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সাংসদ আলহাজ্ব জাফর আলম নিহতদের পরিবারের মাঝে এ অনুদান তুলে দেন।

ডুলাহাজারা ইউপি চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর জানান, গত ৮ ফেব্রুয়ারিতে এক দুর্ঘটনায় ছয় ভাই নিহত হওয়ার ঘটনা সারাদেশে শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ দুর্ঘটনায় পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেছে। নিহতদের সন্তান ও স্ত্রীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর আমি (চেয়ারম্যান) আবেদন করেছিলাম। চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব জাফর আলমের সুপারিশে আবেদনটি আমলে নিয়ে নিহত ছয় ভাইয়ের পরিবারের জন্য ৩৫ লাখ টাকা অনুদান ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে নিহতের পরিবারের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের ৩৫ লাখ টাকার সহায়তায় তুলে দেয়া হয়। এছাড়াও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষথেকে নিহতদের প্রতিটি পরিবারকে জমিসহ সেমিপাঁকা আটটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।

উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশ্বে ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উত্তর পাশে ১৬ শতক সরকারি জমিতে পিকআপ চাপায় নিহত ছয় ভাইয়ের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষথেকে জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। নিহতদের পরিবারের জন্য ওই ১৬ শতক জমিতে আটটি সেমিপাঁকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘরে দুটি বেডরুম, বারান্দা, একটি বাথরুম ও একটি রান্না ঘর থাকবে। এসব ঘর নির্মাণের জন্য প্রতি ঘরের জন্য চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষথেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

ঘর নির্মাণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে দূর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া নিহতদের ছোট ভাই প্লাবন শীল বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের বেশ কয়েকটি জমি দেখানো হয়। এসব জমি থেকে পরিবারের সকলের সাথে আলাপ করে বর্তমানে যে জায়গায় ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে তা নির্ধারণ করা হয়। এসময় কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, সরকার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে আমাদের পাশে এসে সহযোগীতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের এই ঋণ কখনও শোধ করতে পারবোনা।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, একটি পরিবারের ছয়জন লোক একসাথে সড়কে প্রাণ হারানোর ঘটনা খুবই নজিরবিহীন। যেন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের ঘটনা। এ দুর্ঘনাটি সারাদেশে শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নিহতদের পরিবারের এ ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব না। তারপরও ঘটনার পর থেকে উপজেলা প্রশাসন ও সরকারের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে নিহতদের পরিবার যে জায়গার মধ্যে রয়েছে তা বনবিভাগের জায়গা। ডিসি স্যারের নির্দেশে তাদের স্থায়ী একটি জায়গায় পূর্ণবাসন করার জন্য নির্দেশ দেন। ডিসি স্যারের নির্দেশনার আলোকে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সম্মতিতে জায়গাটি নির্ধারন করা হয়। সম্প্রতি সময়ে ডিসি স্যার নিহতদের পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করে গেছেন। আশা করছি খুব শীঘ্রই ঘর নির্মাণের কাজ শেষ করে তাদের কাছে হস্তান্তর করতে পারবো।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: দুর্ঘটনা, নিহত, সড়ক
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন