বন্য হাতিকে পোষ মানানোর প্রশিক্ষণ অমানবিক ব্যাপার

আ ল ম ফজলুর রহমান

(১৫)

প্রেসিডেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জামাইছড়ি থুম ক্যাম্প পরিদর্শনের পরে জামাইছড়ি থুম ক্যাম্প থেকে ফারুয়ায় ব্যাটালিয়ান সদরে ফিরে এলাম। হাত পা ছেড়ে বিশ্রাম নিলাম।

পরদিন পুর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক চট্রগ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী হাজি কবির চৌধুরী এবং পাহাড় থেকে বিশাল বিশাল কর্তিত গাছ পাহাড়ী পথে হাতি দিয়ে টেনে রেংখিয়াং খাল পর্যন্ত আনার কাজে নিয়োজিত চৌদ্দটি পোষা হাতির মালিক সিলেটের জৈন্তাপুরের আম্বিয়া চৌধুরী ফারুয়াতে ব্যাটালিয়ান সদরে আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। কাঠ ব্যবসায়ী হাজি কবির চৌধুরী ছোটখাটো হালকা পাতলা ফর্সা মুখভর্তি দাড়ি শোভিত সৌম্যকান্তির ভদ্র মানুষ। অন্যদিকে আম্বিয়া চৌধুরী একজন সুপুরুষ বলতে যা বুঝায় তাই। যেমন লম্বা দোহারা গড়ন তেমনি ফর্সা গায়ের রং।

আমি ১৯৮২ সালের কথা বলছি । ঐ সময় ফারুয়ার দক্ষিণে গভীর প্রাইমারি জঙ্গল কেটে বনায়নের কাজ চলছিলো। আমি বনায়ন বলতে বুঝাচ্ছি বনবিভাগ গভীর প্রাইমারি জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছ কেটে বন পরিষ্কার করে তার কোনোটাতে সেগুন, কোনোটাতে জারুল গাছের চারা রোপনের কাজ করছিলো। হাজি কবির চৌধুরী বনবিভাগের কাছ থেকে এইসব প্রাইমারি জঙ্গলের গাছের লট নিলামে কিনে লটের জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছ কেটে আম্বিয়া চৌধুরীর পোষা হাতি দিয়ে ঐসব গাছ টেনে এনে রেংখিয়াং খালে ফেলে ঐসব কর্তিত গাছের প্রায় কিলোমিটারের মতো লম্বা ভেলা বানিয়ে তা কাপ্তাই লেকে এনে নোঙর করে ঐসব কর্তিত গাছ বিক্রয়ের জন্য চট্টগ্রামের কাঠের বাজারে আসতো। পরে চট্রগ্রাম থেকে ঐ গাছগুলো ঢাকার কাঠের বাজারে আসে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহারের জন্য।

হাজি কবির চৌধুরী এবং আম্বিয়া চৌধুরীর সঙ্গে তাদের কর্মকান্ড নিয়ে বিশদ আলোচনা করলাম। আলোচনায় বুঝলাম কাঠ ব্যবসায়ী হাজি কবির চৌধুরী এবং পোষা হাতির মালিক সিলেটের জৈন্তাপুরের আম্বিয়া চৌধুরী ফারুয়াতে ব্যাবসা করছেন শান্তিবাহিনীকে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে। আমি এও বুঝতে পারলাম ফারুয়ার হেডম্যান তজেন্দ্রলাল তনচ্যঙ্গা শান্তিবাহিনীর চাঁদার সমন্বয়ের কাজটি করেন ফারুয়াতে ফারুয়া বাজার সহ সব ব্যবসায়ীর সাথে। কাঠ ব্যবসায়ী হাজি কবির চৌধুরী কাপ্তাই থেকে প্রতিদিন লঞ্চে রেংখিয়াং খাল দিয়ে ফারুয়া আসেন এবং সন্ধ্যায় লঞ্চে কাপ্তাই ফিরে যান। অন্যদিকে অম্বিয়া চৌধুরী ফারুয়াতে তার নিজের হাতিশালে থাকেন।

আমি আম্বিয়া চৌধুরীকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম ফারুয়াতে ব্যটালিয়ান সদরে আমাদের সাথে থাকতে কিন্তু তিনি থাকেননি। আমি ফারুয়া হতে চলে আসার পরে শুনেছিলাম শান্তবাহিনীর লোকেরা আম্বিয়া চৌধুরীকে মেরে ফেলে। রেংখিয়াং খাল দিয়ে শুধু কাঠের বিশাল বিশাল ভেলা আসে তা নয়। ফারুয়া হতে সাত/ আট কিলোমিটার পুর্বে কর্ণফুলী পেপার মিলের পাল্পের জন্য ব্যবহৃত বিশাল বিশাল পাহাড়ী বাঁশবন আছে। এই পাহাড়ী বাঁশও প্রায় কিলোমিটার লম্বা ভেলার মতো ভেসে রেংখিয়াং খাল দিয়ে কাপ্তাই পেপার মিলে যায় মন্ড তৈরির জন্যে।

ফারুয়া বাজার এই অঞ্চলের একমাত্র সমৃদ্ধ বাজার। এখানে দুরদুরান্তের পাহাড়ী গ্রামের বাসিন্দারা বাজার করতে আসে। ব্যাবসায়ীরা সবাই প্রায় চট্টগ্রামের মানুষ। রেংখিয়াং খালের পুর্ব পাড়ে ফারুয়া ব্যাটালিয়ান সদরের পুর্বে সন্নিকটে। বাজারে সব সামগ্রী পাওয়া যায়।

হাতির পাল

মজার ব্যপার হলো এই বজারে তর্জাঘেরা খড়ের চালের আবাসিক হোটেল আছে । দুরের পাহাড়ী গ্রামের বাসিন্দারা রাতে গ্রামে না ফিরে বাজারের আবাসিক হোটেলে রাত যাপন করে । তক্তানালা ফারুয়া ইউনিয়নের ইউনিয়ন সদর। আমি এখানে বন্য হাতির পোষ মানানোর কঠিন প্রশিক্ষণ অবলোকন করেছি। ঐসময় ফারুয়ার আশপাশের পাহাড়ে বন্য হাতি ধরার ব্যবস্থা ছিলো।

আমি হাতির মাহুতকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলাম, কিভাবে তারা বন্য হাতি ধরে? জবাবে মাহুত বলেছিলো, প্রথমে তারা খবর সংগ্রহ করে কোন এলাকায় বন্য হাতি আছে । খবর নিশ্চিত হলে মোটা রশিসহ দুজন মাহুত দুটি প্রশিক্ষিত হাতি নিয়ে ঐ জঙ্গলে যায় যেখানে বন্য হাতি আছে। তার পরে একটা মাঝারি সাইজের হাতিকে বন্য হাতির পাল থেকে আলাদা করে প্রথমে ঐ হাতিকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পোষা দুই হাতির মাঝখানে এনে এই দুই হাতি বন্য হাতিকে এমন ভাবে চেপে ধরে যে সে আর নড়াচড়া করতে পারেনা। পরে দুজন মাহুত দুদিক থেকে বন্য হাতির গলায় রশি পরিয়ে দিয়ে পোষা হাতির সাথে তা বেঁধে দেয়। তখন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুই হাতি তাকে টানতে টানতে সামনে নিয়ে আসে।

এভাবেই তারা বন্য হাতিকে প্রশিক্ষণ এলাকায় নিয়ে এসে তার চার পায়ে শিকল বেঁধে দিয়ে এমনভাবে খুটির সাথে টানা দিয়ে বাঁধে যে বন্য হাতিটি না শুইতে পারে না দাঁড়িয়ে থাকতে পারে । তার পরে তার উপরে শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। রশি দিয়ে বন্য হাতিটিকে এমনভাবে পিছমোড়া দিয়ে বাঁধা হয় যখন তাকে গোসলের জন্য রেংখিয়াং খালের পানিতে নামানো হয় তখন ঐরশী পানিতে ভিজে হাতির শরীরে এমন ভাবে চেপে বসে যার যন্ত্রণায় বন্য হাতিটি গগন বিদারী চিৎকার দিতে থাকে।

একদিন আমি ষ্পিডবোটে কাপ্তাই হতে ফারুয়া আসার পথে তক্তানালাতে এইরকম পানিতে হাতির চিৎকার শুনে মাহুতকে বাধ্য করেছিলাম হাতির বাঁধন খুলে দিতে। একদিন প্রায় কয়েক ঘন্টা আমি বন্য হাতির প্রশিক্ষণ দেখেছিলাম। ঐ হাতিটা ছিলো একটা পোষা হাতির বাচ্চা। দেখলাম মাহুতের কথা না শুনলে মা পোশা হাতি তার নিজের বাচ্চাকে শুঁড় দিয়ে মারছে। বন্য হাতিকে পোষ মানানোর প্রশিক্ষণ একটি অমানবিক ব্যাপার। এটা দেখে সবার সহ্য হবে বলে হনে হয় না।

চলবে….

মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন