মাতামুহুরী নদীর অব্যাহত ভয়াবহ ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে জনবসতি: আতঙ্কে হাজারও পরিবার

চকরিয়া প্রতিনিধি:

কক্সবাজারের চকরিয়ায় উপজেলার মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন জনপদে আবারও ভয়াবহ ভাঙ্গনের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ঈদের আগে টানা এক সপ্তাহ ধরে অবিরাম ভারী বৃষ্টিপাতের জেরে নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানি কমে যাওয়ার পরপর নদীর দুই তীরে বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয়েছে ভাঙ্গনের খেলা। তাতে ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ৩০টি বসতঘর। বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে আরও শত শত বসতঘর, দোকান-পাট, মসজিদ, মাদ্রাসা ও নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে ভাঙ্গনে আতঙ্কে বর্তমানে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন উপজেলার হাজারও পরিবার। এ অবস্থার কারণে নদীর তীর লাগোয়া এলাকায় বসবাসরত প্রায় লক্ষাধিক জনসাধারণ নদীর ভাঙ্গনে চরম আতঙ্কে ভুগছেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেয়া পরিসংখ্যান মতে জানা গেছে, ইতোমধ্যে নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বিগত দুই দশকে ভিটেবাড়ি হারিয়ে কমপক্ষে ১০হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছেন। এসব পরিবার বেঁচে থাকার তাগিদে ঠাঁই নিয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে। নদীতে বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে পৌরসভার গুরুত্বপুর্ণ শহররক্ষা বাঁধ ও ছিকলঘাটা-কৈয়ারবিল সড়ক, ভাঙ্গারমুখ ফাঁসিয়াখালী ঘুনিয়া সড়ক।

লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার বলেন, তার ইউনিয়নে মাতামুহুরী নদীর তীর এলাকায় প্রায় ৬হাজার মানুষের বসবাস। নদী ভাঙ্গনের ফলে ইউনিয়নের বেশিরভাগ জনগণের মাঝে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। শুষ্ক মৌসুম যেমন তেমন বর্ষাকালে বেড়ে যায় আতঙ্কের মাত্রা। তিনি বলেন, ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে বর্ষাকালে যে কোন সময় নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে এলাকার ফসলী জমি, খতিবে আজমসহ বেশ ক’টি সড়ক, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিম খানাসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

কৈয়ারবিল ইউপি চেয়ারম্যান মক্কী ইকবাল হোসেন বলেন, প্রতিবছর বর্ষাকালে মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে কৈয়ারবিল ইউনিয়নে নদীর তীর এলাকার বিপুল জনবসতি ভাঙ্গনের কবলে পড়ে নদীতে বিলীন হচ্ছে। এবছরও বর্ষাকালের শুরুতে কয়েকদফা বন্যায় তার ইউনিয়নের দক্ষিন খিলছাদক এলাকার লামারপাড়া ও মন্ডলপাড়া গ্রামে ব্যাপক ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কটি বসতবাড়ি ও আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কয়েক বছরের মধ্যে কৈয়ারবিল ইউনিয়নের আয়তন ছোট হয়ে যাবে। এতে এলাকার অনেক পরিবার ভিটেমাটি হারাবে।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, চলতি মৌসুমের বর্ষার শুরুতে পৌরসভার বিভিন্ন জনপদে বিশেষ করে মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক নদী ভাঙ্গনের শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে পৌরসভার ৮নম্বর ওয়ার্ডের কোচপাড়া পয়েন্টের বিশাল এলাকা নদীতে তলিয়ে গেছে। অন্তত ১০-১২টি বসতঘর এবারের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এখনো কোচপাড়া, নামার চিরিঙ্গা, মজিদিয়া মাদ্রাসা ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ঘুনিয়া দিগরপানখালী পয়েন্টে নদীতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম অবস্থায় রয়েছে শতাধিক বসতঘর, দোকানপাট ও মসজিদ মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। তিনি বলেন, ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে পৌরসভার ১নম্বর ওয়ার্ডের ছাবেতপাড়া, চরপাড়া, কাজীরপাড়া, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তরছঘাটা, জলদাশপাড়া ও বাটাখালী সেতুর দুই পাশের চারটি গ্রামের অন্তত দুই শতাধিক বসতঘর।

উপজেলার কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত ওসমান বলেন, মাতামুহুরী নদী সৃষ্টির পর থেকে কাকারাবাসি ভাঙ্গনের তাণ্ডবের সম্মুখীন। ইতোমধ্যে নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ইউনিয়নের হাজারও বসতি বিলীন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, অতীতের মতো এবছর বর্ষার শুরুতে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার তাণ্ডবে নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে ইউনিয়নের মাঝেরফাড়ি, ইউনিয়ন পরিষদের সামনের এলাকা, কামাল উদ্দিন মাস্টারের ঘাটা, রুদ্রপাড়াসহ আশপাশ এলাকার বিপুল জনবসতি। এমনকি ভাঙ্গনে বিলীন হতে উপক্রম হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান ভবনটি।

জানা গেছে, ১৯৯১সালে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড়ের পর চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীতে ভাঙ্গনের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। এখনো প্রতিবছর বর্ষাকালে নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রবল স্রোতের টানে অব্যাহত রয়েছে নদী ভাঙ্গনের ভয়াবহতা। এই ভয়াবহতার কবলে পড়ে গেল দুই দশকে উপজেলা ও পৌরসভা এলাকার প্রায় ১০হাজার পরিবার ভিটেবাড়ি হারিয়ে গৃহহারা হয়েছে।

সরেজমিনে জানা গেছে, বর্তমানে চকরিয়া উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নের বাটাখালী নাপিতের টোড়া ও উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল, বিএমচর, বরইতলী, পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়নের আনিছপাড়া, বেতুয়াবাজার সেতু পয়েন্ট, সমসু মিয়ার হাটস্থ জলদাশপাড়া পয়েন্ট, কোণাখালী ইউনিয়নের কন্যারকুম, বাংলা বাজার, সিকদাপাড়া পয়েন্ট ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর, বুড়িপুকুর পয়েন্টেসহ একাধিক জনপদ ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া শাখা কর্মকর্তা (এসও) তারেক বিন সগীর বলেন, মাতামুহুরী নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে পাউবো ইতোমধ্যে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছেন। বিশেষ করে নদীর ঝুঁকিপুর্ণ পয়েন্টে বসানো হচ্ছে সিসি বক্লদ্বারা টেকসই স্পার। তিনি বলেন, নতুন করে যেসব এলাকায় নদীর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তা সনাক্ত করে সমীক্ষার মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দের জন্য উর্ধ্বতন দপ্তরে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। অর্থ বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে উপজেলার সবখানে ভাঙ্গন প্রতিরোধে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন