গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য

পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের কাছে ৫৪ রকেট লঞ্চার ১৪৪ এলএমজি ৬৪১ এসএমজিসহ ৪ হাজার অস্ত্র

fec-image

আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ৬ বছরে খুন ৩২১। ২০১৮ সালে ৬৮ জন এবং ২০১৫ সালে ৬৯ জন খুন হন। ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছেন ৫৬ জন। এছাড়া ২০১৪ সালে ৫৪ জন, ২০১৬ সালে ৪১ জন এবং ২০১৭ সালে ৩৩ জন খুন হয়েছেন।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২২ বছর পরও শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে। চার সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনে জিম্মি হয়ে পড়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বছরের পর বছর ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। গত ৬ বছরে এসব ঘটনায় খুন হয়েছেন ৩২১ জন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সশস্ত্র আঞ্চলিক দলের আধিপত্যের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে মূলধারার রাজনীতি করতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। যারা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। হুমকিতে কাজ না হলে তাদের হত্যা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের অনেক পদধারী নেতাও আঞ্চলিক সংগঠনের হাতে খুন হয়েছেন। তাদের হুমকিতে বিভিন্ন সময়ে ৩৫৫ আওয়ামী লীগ নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন অনুসন্ধান এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।

শুধু তাই নয়, চারটি আঞ্চলিক সংগঠন- জনসংহতি সমিতি (জেএএসএস-মূল), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) কাছে ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র থাকারও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- রকেট লঞ্চার ৫৪টি, এসএমজি ৬৪১টি, বিভিন্ন ধরনের রাইফেল ৫৯৪টি এবং হাতবোমা আছে এক হাজারেরও বেশি। এছাড়া চার শতাধিক দেশি পিস্তল ও বন্দুক এবং ৪০টি মর্টার রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আছে জেএসএস(মূল) এবং ইউপিডিএফের (মূল) কাছে। ভয়াবহ এসব মারণাস্ত্র দেশের বাইরে থেকে সংগঠনগুলো সংগ্রহ করেছে বলে জানতে পারে গোয়েন্দা সংস্থা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (মনোনীত) কংজরী চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ১৯৯৭ সালে জেএসএসের (মূল) সঙ্গে সরকার শান্তিচুক্তি করেছে।

এখন তাদের কাছে নীতিগতভাবে অস্ত্র থাকার কথা নয়। কাদের কাছে অস্ত্র আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেটি খুঁজে বের করতে হবে। আমরা প্রতিবারই বলছি, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাতে হবে।

তিন পার্বত্য জেলার আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভায়ও আমরা বারবার বলছি, যে কোনো উপায়েই হোক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।

আঞ্চলিক দলগুলো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রাজনীতি করতে দিচ্ছে না- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দল। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে দিচ্ছে না, তাদের কেন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না।

আর যদি তাদের নিষিদ্ধ করা না হয়, তবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হোক।

খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এখানে আঞ্চলিক যে সংগঠনগুলো আছে, তারা দ্বিধাবিভক্ত। এ কারণে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

এর ফলে খুনের ঘটনা ঘটে। কোনো কোনো সংগঠন শান্তি চুক্তির পক্ষে। আবার কোনো কোনো সংগঠন শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে। এখানে তাদের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্বতো আছেই। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তারা অনেক কোণঠাসা অবস্থাতে আছে।

ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রধান শ্যামল চাকমা যুগান্তরকে বলেন, আমরা শান্তি চুক্তির পক্ষে কাজ করছি। আমরা পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তির ২২ বছর পূর্তিতে আমরা কর্মসূচি পালন করব।

একই সঙ্গে জেএসএস (সংস্কার) পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি।

ইউপিডিএফ (মূল) থেকে বেরিয়ে আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউপিডিএফ গঠন করা হয়েছিল, সেই আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছে।

আমরা ভুল বুঝতে পেরে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠন করেছি।

ইউপিডিএফের (মূল) যুব সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি অঙ্গ মারমা যুগান্তরকে বলেন, ইউপিডিএফের (মূল) বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সশস্ত্র হামলাসহ যে ধরনের অভিযোগ করা হয় সেটি একপাক্ষিক।

আমাদের কাছে যদি অস্ত্র থাকত তাহলে আমরা তো খুনের শিকার হতাম না।

জেএসএসের (মূল) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক কেএস মং মারমার সেলফোনে শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

হানাহানির জনপদ : গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, চার আঞ্চলিক দলের চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গত ৬ বছরে ৩২১ জন খুন হয়েছেন।

এরমধ্যে পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ২০৭ জন এবং বাঙালি খুন হয়েছেন ১১৪ জন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ ও ২০১৫ সালে সালে।

২০১৮ সালে ৬৮ জন এবং ২০১৫ সালে ৬৯ জন খুন হন। ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছেন ৫৬ জন। এছাড়া ২০১৪ সালে ৫৪ জন, ২০১৬ সালে ৪১ জন এবং ২০১৭ সালে ৩৩ জন খুন হয়েছেন।

আরও জানা গেছে- ২০১৮ সালের ৩ মে ইউপিডিএফের (মূল) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলি করে জেএসএস (সংস্কার) সমর্থক নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে।

এর একদিন পর শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ইউপিডিএফ (মূল) সন্ত্রাসীরা ব্রাশফায়ার করে ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রধান তপন জ্যোতি চাকমাসহ পাঁচজনকে হত্যা করা হয়।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ (মূল) থেকে একটি অংশ তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে বেরিয়ে এসে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠন করে। ইউপিডিএফ (মূল) সংগঠনটি শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গঠিত হলেও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) শান্তিচুক্তির পক্ষে অবস্থান নেয়।

অপরদিকে ২০০৭ সালে গঠিত জেএসএস (সংস্কার) অংশটিও আদর্শিক কারণে জেএসএস (মূল) থেকে বেরিয়ে এসে নতুন একটি সংগঠন গঠন করে। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠন করার পর এ দুটি সংগঠন একসঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে।

ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠন করার পর ২০১৮ সালে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য অঞ্চলে সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট চরম আকার ধারণ করে।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মে মাসের শুরুতে নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা খুন হওয়ার আগে ও পরে পার্বত্য অঞ্চল আরও অশান্ত হয়ে উঠে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি দক্ষিণ পানহাইয়া পাড়া এলাকায় ইউপিডিএফের (মূল) সমর্থক মিঠুন চাকমাকে হত্যা করে জেএসএস (সংস্কার)। ২১ ফেব্রুয়ারি দীঘিনালায় যৌথ খামার বাগান এলাকায় ইউপিডিএফের (মূল) একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে জেএসএস (সংস্কার)।

১০ মার্চ বাঘাইহাট বালুখালী এলাকায় ইউপিডিএফের (মূল) একজন সদস্যকে হত্যা করে জেএসএস (সংস্কার)। ১১ এপ্রিল ইউপিডিএফের (মূল) সমর্থক জনি তঞ্জগ্যাকে গুলি করে হত্যা করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।

একই দিন ক্যাংড়াছড়ি এলাকায় জেএসএসের (সংস্কার) সমর্থক সাধন চাকমাকে হত্যা করে ইউপিডিএফ (মূল)। ওইদিনই জেএসএসের (সংস্কার) হাতে ইউপিডিএফের (মূল) এক সদস্য খুন হন।

পাল্টাপাল্টি ইউপিডিএফের (মূল) হাতে জেএসএসের (সংস্কার) এক সদস্য খুন হন। এভাবে প্রতিনিয়তই বছরজুড়ে একের পর এক পাল্টাপাল্টি হামলা এবং খুনের ঘটনা ঘটেছে পুরো পার্বত্য অঞ্চলে।

এদিকে চলতি বছরজুড়ে পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র আঞ্চলিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একের পর এক খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি মারিশ্যার বাবুপাড়া এলাকায় জেএসএস (মূল) এবং জেএসএসের (সংস্কার) মধ্যে গুলি বিনিময়ে জেএসএসের (সংস্কার) সদস্য বাবু চাকমা নিহত হন।

এ ঘটনার ১০ দিন পর ১৪ জানুয়ারি রামগড়ের জগন্নাথপাড়া এলাকায় জেএসএসের (সংস্কার) সাংগঠনিক সম্পাদক মোহন ত্রিপুরাকে ইউপিডিএফ (মূল) গুলি করে হত্যা করে। সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর রাজস্থলী উপজেলার বালুমারা এলাকায় জেএসএসের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জেএসএসের (মূল) তিন সদস্য নিহত হন।

দল ত্যাগ করলেই খুন : পার্বত্য অঞ্চলে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সশস্ত্র আঞ্চলিক দলে একবার যোগ দিলে সেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। কেউ যদি দল থেকে বের হয়ে যায় তবে তাকে খুন করতে মরিয়া হয়ে উঠে সংগঠনের সদস্যরা।

ইউপিডিএফ (মূল) থেকে বেরিয়ে আসার পর খুনের শিকার তিন তরুণের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, দলত্যাগ করার পর প্রকাশ্যে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়েছে।

তাদের শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, পরিবারের সদস্যদেরও নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের গতিবিধি সার্বক্ষণিক লক্ষ্য করছে তারা।

মূলধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন : একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফ (মূল) বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলো তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে দেশের বাইরে থেকে ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র সংগ্রহ করছে।

আধিপত্য চিরস্থায়ী করতে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। এমনকি পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনকারী সংগঠন জেএসএস (মূল) আওয়ামী লীগ নেতাদের দল ছাড়তে গোপনে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে তাদের হুমকিতে ৩৫৫ আওয়ামী লীগ নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। যারা তাদের হুমকি উপেক্ষা করে রাজনীতি করছেন তাদের অনেককেই এরই মধ্যে হত্যা করা হয়েছে।

এরমধ্যে বান্দরবান সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি মং প্রু মারমা, বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ কান্তি তংচংগ্যা, বান্দরবান পৌর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি চ থোয়াই মং মারমা, বোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মং মং থোয়াই মারমা, রাজস্থরী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ক্যহ্লাচিং মারমা এবং লামা উপজেলার সড়ই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আলমগীর শিকদার উল্লেখযোগ্য।

সূত্র- যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অস্ত্র, পাহাড়ী সন্ত্রাসী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন