টেকনাফ অপহৃত তিন বনপ্রহরী জীবিত উদ্ধার, অস্ত্রসহ গ্রেফতার ১

fec-image

কক্সবাজারের টেকনাফে বন পাহারা দিতে গিয়ে অপহৃত তিন বন প্রহরীকে ৭২ ঘণ্টা পর গহীন পাহাড়ের ভেতর থেকে স্থানীয় জনতা ও বনবিভাগের সদস্যদের সহযোগিতায় পুলিশ তাদের জীবিত উদ্ধার করেছে। এসময় দেশীয় তৈরি একনলা লম্বা ২টি বন্দুক ও ৫ রাউন্ড তাজা কার্তুজসহ অপহরণকারী দলের এক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তি মহেশখালী উপজেলার কালামারছড়ার বাসিন্দা মো. ফয়সাল (২৮)।

উদ্ধার তিন প্রহরী হলেন- টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া এলাকার আবদুল মালেকের ছেলে মোহাম্মদ শাকের(২০), বকসু মিয়ার ছেলে আবদুর রহমান(৪২) ও আবদুস শুক্কুরের ছেলে আবদুর রহিম(৪৬)।

সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের পাহাড় থেকে স্থানীয় জনতা, পুলিশ ও বন বিভাগের লোকজন তাঁদের উদ্ধার করেন।

এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম।

সোমরার রাত ৮টার দিকে টেকনাফ মডেল থানার সম্মেলন কক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া-টেকনাফ) সার্কেল রাসেল পিপিএম সেবা লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ, পুলিশ পরিদর্শক মো নাসির উদ্দিন মজুমদার, পরিদর্শক (অপারেশন) আব্দুর রাজ্জাক ও বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো মিজানুর রহমান।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল বলেন, গত শুক্রবার দিন ৩ বন প্রহরী আবদুর রহমান, মো. শাকের ও আবদুর রহিম দমদমিয়া নেচার্র পার্ক সংলগ্ন পাহাড়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। হঠাৎ এমন সময় ১০-১৫ জনের একটি ডাকাতদল তাদের অস্ত্রেরমুখে জিম্মি করে পাহাড়ের ভেতর নিয়ে যায়। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ ছিল। অপহরণের পর থেকে আমরা একাধিকবার পাহাড়ের ভেতর অভিযান পরিচালনা করে আসছিলাম। অভিযান চলাকালীন সোমবার বিকেলে গহীন পাহাড়ে তাদের অবস্থান শনাক্ত করে আমরা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তখন সন্ত্রাসী/ডাকাতদল পুলিশের উপর গুলিবর্ষণ করেন। এসময় পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলিবর্ষণ করলে ডাকাতদল অপহৃত তিন প্রহরীকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় এবং হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তিনজনকে উদ্ধার করি। পরে আমরা ঘটনাস্থল তল্লাশি করে দু’টি একনলা দেশিয় তৈরি বন্দুক ও ৫ রাউন্ড তাজা কার্তুজসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়।

উদ্ধার হওয়া বন প্রহরী আবদুর রহমান বলেন, ঘটনায় দিন আমরা নিয়মিত বন পাহারা দিচ্ছিলাম। এমন সময় একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আমাদেরকে জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে গহীন পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়। আটকের পর মুক্তিপণের টাকার জন্য মারধর করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালায়। পরে আমাদের সঙ্গে থাকা মুঠোফোনের মাধ্যমে পরিবারের কাছে ফোন করে প্রত্যেকজন থেকে ২০ লাখ করে ৬০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয় । গহীন পাহাড়ের ভেতর আটকে রেখে আমাদের ঠিকমত খেতে দেয়নি। পরেরদিন রবিবার দুপুরে নির্যাতনের মাত্রা বাড়াতে থাকেন। আবারো পরিবারে ফোন করে জনপ্রতি ১০ লাখ করে ৩০ লাখ টাকার মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অন্যথায় আমাদের মেরে ফেলা হুমকি দেন। পুলিশ ও স্থানীয়রা আমাদের খোঁজে পাহাড়ে আসলে আমরা তাদের দেখলেও তখন শৌর চিৎকার বা ডাক দিতে পারিনি। সন্ত্রাসীরা তখন আমাদের অস্ত্র ঠেকিয়ে রাখেন। ওসময় কাপড় দিয়ে আমাদের মুখগুলো বাঁধা ছিল।

সোমবার পুলিশ, বনবিভাগ ও স্থানীয় লোকজন পাহাড়ে চারপাশ ঘিরে রেখে অভিযান পরিচালনা করলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলে তখন আমরা তাদের কবল থেকে উদ্ধার হতে পারেছি।

টেকনাফ রেঞ্জ কর্মকর্তা মো মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে নেচারপার্ক মোচনী বন পাহারা দলের সভাপতি মোহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, সন্ত্রাসীরা ১৬ থেকে ১৮ জনের মতো ছিল। প্রায় দুই শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা, বনকর্মী, পাহারা দলের পিসিজি সদস্য, পুলিশ ও স্থানীয় ইউপি সদস্যেরা অভিযানে অংশ নেন। গহিন পাহাড়ের ভেতরে অপহৃত তিনজনকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে তাঁদের ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নুরুল বশর বলেন,তিন বন প্রহরী অপহরণের পর থেকে তাদের পরিবারের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তারা চিন্তায় ছিল তাদের জীবিত ফেরত পাওয়া যাবে কিনা। এমন সময় দীর্ঘ ৭২ ঘণ্টা পর বনবিভাগ, সিপিজি ও স্থানীদের সহযোগিতায় পুলিশ তাদের গহীন পাহাড় থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, বন প্রহরী তিনজন অপহৃত হওয়ার পর এলাকাবাসী, স্থানীয় পুলিশ ও বনবিভাগ প্রত্যেকের সহযোগিতায় তাদের জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

এ ব্যাপারে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ বলেন, দীর্ঘ ৭২ ঘণ্টা অভিযানের পর অপহৃত তিন বনপ্রহরীকে গহীন পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া তিন বন প্রহরীকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে তাদের কক্সবাজার আদালতে বিজ্ঞ বিচারক অপহরণের শিকার তিনজন বন প্রহরীর কাছ থেকে জবানবন্দি রেকর্ড করার পর তাদের পরিবারের কাছে স্থানান্তর করা হবে।

উল্লেখ্য, গত ৮ মাসে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৮৩ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৩৯ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকি ৪৪ জন রোহিঙ্গা। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৩৯ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপহরণ, অস্ত্র, গ্রেফতার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন