বাংলা ভাষার অন্য রকম ভালোবাসার উৎসব

fec-image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) একদল তরুণ সিনেমাপ্রেমীর তুমুল আড্ডা আর চা–চক্র চলছে। ক্লাসের পাঠ চুকিয়ে তাঁদের আড্ডায় জায়গা পায় দেশ–বিদেশের সিনেমাসহ শিল্পচর্চার নানা বিষয়। হঠাৎ সেই আড্ডায় আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা। কারণ, ২০০২ সাল ছিল ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি।

বাংলা ভাষা ও শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নানা আয়োজন ছিল দেশে। চলচ্চিত্র সংসদের জ্যেষ্ঠ সদস্য রাশেদুল হাফিজ প্রস্তাব তোলেন, ভাষার মাসে শুধু বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র দিয়ে উৎসব করা হবে। সবার মনে ধরে রাশেদুলের প্রস্তাব। কারণ, সেই সময় বাংলা সিনেমা নিয়ে উৎসব তেমন ছিল না। সেবারই প্রথম বাংলা ভাষার ছবি দিয়ে সাজানো হয় ‘চলচ্চিত্রে বাংলার মুখ’ নামে উৎসব। পরে ২০০৭ সাল থেকে নাম বদলে হয়েছে ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র’ উৎসব। দেখতে দেখতে সেই উৎসব পেরিয়ে গেল দুই দশক। গতকাল রোববার শুরু হয়েছে ২১তম উৎসব।

এবারের উৎসবে দেখানো হবে ২২টা সিনেমা। এর মধ্যে ১৯টি পূর্ণদৈর্ঘ্য, ৩টি স্বল্পদৈর্ঘ্য। বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যপূর্ণ সিনেমা দিয়ে সাজানো হয়েছে পাঁচ দিনের এই আয়োজন। থাকছে ব্যবসাসফল হাওয়া থেকে বিকল্প ধারার ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, ‘সাঁতাও’

ছবিগুলোয় বাংলা ভাষা নানাভাবে প্রাণ পেয়েছে। এই আয়োজনে ঘুরেফিরে উঠে এল সূচনালগ্নের কথা। বর্তমান চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি শিয়ান শাহরিয়ার বলেন, ‘ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই এই উৎসবের মূলকথা। বাংলা ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, সেই বাংলা ভাষার সিনেমা নিয়ে কেন উৎসবের আয়োজন করছি না—এমন প্রশ্ন দিয়ে উৎসব শুরু। কারণ, সেই সময় বেশির ভাগ চলচ্চিত্র সংসদে দেখানো হতো বিদেশি ভাষার সিনেমা। এর মধ্যে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র দিয়ে সাজানো আয়োজন নিয়ে দর্শকদের বিপুল আগ্রহ তৈরি হয়। সেই আগ্রহ এখনো আমরা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের স্বাধীনতা, বিকাশ ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করার চেষ্টা করে যাই।’

দেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনে সব সময়ই সামনে থেকেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ। স্বাধীনভাবে গল্প বলা, শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণ, মননশীল দর্শক তৈরি, বাংলা চলচ্চিত্র এগিয়ে নিতে কাজ করে গেছে ছাত্রদের এই সংগঠন। কোনো আন্দোলনে সংগঠনের সদস্যরা যেমন সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজপথে, তেমনি দর্শকদের জন্য সাংস্কৃতিক নানা আয়োজনে প্রশংসা কুড়িয়েছে সংসদ। নব্বইয়ের দশক ও পরবর্তী সময়ে বাংলা সিনেমার পাশাপাশি নিয়ম করে অস্কার একাডেমি, কান, বার্লিন, ভেনিসসহ নানা নামীদামি চলচ্চিত্র উৎসবের পুরস্কারজয়ী সিনেমাগুলো দেখানো হতো। উদ্দেশ্য ছিল, দেশের দর্শকদের সঙ্গে বিদেশি সিনেমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেসব সিনেমার মধ্যে জায়গা পেত আলফ্রেড হিচকক, আন্দ্রেই তারকোভস্কি, লুই বুনুয়েল, জ্যঁ রেনোয়াঁ, জ্যঁ লুক গদার ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে কিম কি দুক, ওং কার ওয়াইদের সিনেমা।

এসব নির্মাতার আলোচিত বিকল্প ধারার সিনেমাগুলো প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হতো না। শাহরিয়ার বলেন, ‘সুস্থধারার বিদেশি সিনেমা অবশ্যই দেখার প্রয়োজন আছে। সেগুলো আমরা প্রদর্শন করি। কিন্তু ভাষার মাসে আমরা বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষার গুরুত্ব বহন করে—এমন সিনেমা শিক্ষার্থীদের দেখাতে চাই।’

শুধু সিনেমা দেখানোই নয়, এই আয়োজনে থাকে চলচ্চিত্রকর্মী, নির্মাতা, সমালোচক নিয়ে মুক্ত আলোচনা। এ পর্বে উঠে আসে দেশের চলমান চলচ্চিত্রের সংকট, সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক। এই পর্বের নাম ‘যুক্তি, তর্ক, গপ্প’। উৎসবের দ্বিতীয় দিন ৬ ফেব্রুয়ারি এই পর্বে আলোচনা হবে ‘গণ–অর্থায়নে স্বাধীন চলচ্চিত্র: সম্ভাবনা ও বাস্তবতা’ নিয়ে, পরদিন আলোচনার বিষয় ‘চলচ্চিত্রে সেন্সর: কতটা যৌক্তিক?’, উৎসবের শেষ দিনে আলোচ্য বিষয় ‘বাংলা চলচ্চিত্রের বাজার ও সাম্প্রতিক প্রবণতা’। উৎসবের শেষ দিনে দেওয়া হবে গত এক বছরে মুক্তি পাওয়া সিনেমার মধ্যে সেরা সিনেমার পুরস্কার। সেরা সিনেমার জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ‘বিউটি সার্কাস’, ‘দামাল’, ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, ‘সাঁতাও’ ও ‘শিমু’। এর মধ্যে একটি সিনেমা পাবে হীরালাল সেন পদক। ২০১৭ সাল থেকে এই পদক যোগ হয়েছে। ঢাবি চলচ্চিত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইতমাম ইসলাম বলেন, ‘বৈচিত্র্য রাখতে আমরা কলকাতার বাংলা ভাষার সিনেমাও রেখেছি। অঞ্চল আলাদা হলেও আমাদের ভাষা এক। সেই জায়গা থেকে দর্শকদের জন্য বাংলা সিনেমায় বৈচিত্র্য রাখা হয়েছে।’

এই উৎসবকে ঘিরে সেজেছে টিএসসি চত্বর। এখানেই মূল অডিটরিয়ামে সিনেমাগুলো দেখানো হচ্ছে। সিনেমাগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে আলোচনা। ক্লাসের ফাঁকে কে কোন সিনেমা দেখবেন, সেই হিসাব করে রাখছেন শিক্ষার্থীরা। টিকিটের মূল্য ৫০ টাকা। তবে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য সিনেমা দেখা ফ্রি। উৎসবের প্রথম দিন গতকাল সকাল ১০টায় দেখানো হয় সীমানা পেরিয়ে, ১টায় আনন্দ অশ্রু, সাড়ে ৩টায় বিউটি সার্কাস ও শেষ প্রদর্শনী বিকেল ৬টা ৩০ মিনিটে কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’। একই সময়ে আজ সোমবার দেখানো হবে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’; ‘শিল্প শহর স্বপ্নলোক’; ‘পরবাসী মন আমার’, ‘ঢেউ’, ‘দূরে’ (স্বল্পদৈর্ঘ্য) ও ‘হাওয়া’। আগামীকাল প্রদর্শিত হবে বেহুলা, বাঞ্ছারামের বাগান, মানিক বাবুর মেঘ, ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা। ৮ ফেব্রুয়ারি ‘ইন্টারভিউ’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’, ‘দামাল’। শেষ দিনে দর্শকেরা দেখতে পারবেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শিমু’, সাঁতাও’।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উৎসব, বাংলা ভাষা, ভালোবাসা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন