১০ হাজার মানুষকে চাকমা বর্ণমালা শিখিয়েছেন ইনজেব
মাতৃভাষা জানেন, কিন্তু চেনেন না নিজের ভাষার বর্ণমালা। ইনজেব চাকমার সেই বর্ণমালা শেখার শুরু ১৩ বছর বয়সে। তখন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। পাহাড়ি অনেকের মতো কৃষক পরিবারের সন্তান ইনজেবেরও স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল দেরিতে। চাকমা বর্ণমালা চিনতে গিয়ে দেখা গেল, ইনজেবের মতো অনেকেই তা চেনে না।
মাতৃভাষার বর্ণমালা শেখার গুরুত্বটা খুব করে বুঝলেন। স্বপ্ন বুনলেন নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে বর্ণমালা চেনাতে। সেই স্বপ্নবলে ১৭ বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে চাকমা বর্ণমালা শেখাচ্ছেন ইনজেব। তাঁর উদ্যোগের ফলে এরই মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ চিনেছে চাকমা বর্ণমালা।
৪০ বছর বয়সী ইনজেব চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ির দীঘিনালার পূর্ব কাঁঠালতলী গ্রামে। পেশায় তিনি কৃষক। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গ্রামেই থাকেন। তবে ২০০৪ সাল থেকে বর্ণমালা শেখানোর কাজ তিনি চালিয়ে নিচ্ছেন আনন্দচিত্তে। ইনজেব চাকমা বলেন, ‘১৯৯৪ সালে গৃহশিক্ষক বীর চাকমার কাছ থেকে আমি বর্ণমালা শিখি। তখন থেকে নিজেদের বর্ণমালার গুরুত্ব বুঝি, মনে মধ্যে সংকল্প করি নিজের জাতির বর্ণমালা রক্ষা করার।’
এসএসসি পাস করার পর ইনজেব চাকমার পড়াশোনা আর এগোয়নি। একসময় যুক্ত হন ‘চাঙমা সাহিত্য বা’ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে। এখন তিনি এই সংগঠনের সভাপতি। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর বর্ণমালা শেখানোর কাজ প্রসারিত হতে থাকে। বর্তমানে সংগঠনের ৪৫ সদস্য চাকমা বর্ণমালা শেখানোর কাজ করে যাচ্ছেন। দীঘিনালাসহ খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে চলে চাকমা বর্ণমালা শেখানোর ক্লাস।
১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে ‘চাঙমা সাহিত্য বা’ কার্যালয়ে কথা হয় ইনজেব চাকমার সঙ্গে। তখন তিনি অনলাইন ক্লাসে বর্ণমালা শেখাচ্ছিলেন। পাঠদান শেষে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বললেন, ‘করোনার কারণে বিদ্যালয় যখন বন্ধ হয়ে গেল, আমাদের কার্যক্রমও অনেকটা বন্ধ ছিল। এখন অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি।’
সপ্তাহে এক দিন বর্ণমালা শেখানোর ক্লাস নেন তাঁরা। তিন মাসের কোর্স। সহজভাবে নিজেরা বাতলে নিয়েছেন বর্ণমালা শেখানোর পদ্ধতি। ইনজেব চাকমা জানালেন, চাঙমা সাহিত্য বা সংগঠন থেকে ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৫৩টি কেন্দ্রে ১৬৩টি ব্যাচে ১০ হাজার ৩ জনকে চাকমা বর্ণমালা শেখানো হয়েছে। ৪ হাজার ৮৩ জনকে সনদ দেওয়া হয়েছে। শুধু দীঘিনালার ৯৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে চাকমা বর্ণমালার পাঠদান দেওয়া হয়ে থাকে।
সংগঠনে ইনজেব চাকমার নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবকেরা চাকমা বর্ণমালা শেখান। এই সংগঠন চাকমা বর্ণমালার বই ‘সাঙু’, ‘পত্তম আদি পুদি’ প্রকাশ করেছে। শুধু বর্ণমালার বই নয়, চাকমা সাহিত্য পত্রিকাসহ গল্প, ছড়া ও কবিতার বইও প্রকাশ করে থাকে সংগঠনটি। সংগঠনটির অর্থ সম্পাদক রেমি চাকমা বলেন, ‘আমি নিজেও ইনজেব চাকমার কাছে চাকমা বর্ণমালা শিখেছি। এখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য ও চাঙমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পরিচালক আনন্দ মোহন চাকমা বলেন, ‘ইনজেব চাকমা একজন বর্ণমালাপ্রেমী। দীর্ঘ বছর ধরে তিনি নিজ জাতির ভাষা ও বর্ণমালার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার কারণে এখন আমাদের নিজ জাতির অনেক ছেলেমেয়ে চাকমা বর্ণমালা লিখতে ও পড়তে পারছে।’
ইনজেব চাকমা অবশ্য বলেন, ‘মাতৃভাষাকে ভালোবাসা মানে তো দেশকে ভালোবাসা। আমি ভালোবেসে কাজটি করি।’
সূত্র: প্রথম আলো