‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে যে সরকারি প্রজ্ঞাপন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল
গণমাধ্যমে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করতে সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা একটি প্রজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। গত ১৯ জুলাই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের টিভি-২ শাখা থেকে উপসচিব শেখ শামছুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়।
সংবিধান পরিপন্থী ‘আদিবাসী’ শব্দটি বেপরোয়াভাবে মূলধারার কিছু গণমাধ্যমে ব্যবহার হওয়ায় দীর্ঘদিন থেকে ক্ষোভ রয়েছে সচেতন নাগরিকদের মাঝে। তাই প্রজ্ঞাপনটি শেয়ার করে তারা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে কেউ কেউ প্রজ্ঞাপনের সমালোচনাও করেছেন।
প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই ‘আদিবাসী’ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন। নেটিজেনদের একটি বড় অংশ সংবিধান পরিপন্থী শব্দটির বিরোধিতা করে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং ‘আদিবাসী’ দাবির পক্ষে মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক বিভিন্ন পোস্টের জবাব দিয়েছেন।
১৯ জুলাই প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়/গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।আগামী ০৯ আগস্ট-২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদক সহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
ফেসবুকে প্রজ্ঞাপনটি শেয়ার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক এ এইচ এম ফারুক লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে আদিবাসী যদি না থাকে, তবে সরকারকে আগে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ইত্যাদি নামক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এমপি মন্ত্রীদের ‘আদিবাসী’ শব্দ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। তখন এই প্রজ্ঞাপন সার্থক হবে।’
মাহামুদ চৌধুরী নামে একজন সচেতন নাগরিক লিখেছেন, ‘যারা আদিবাসী তারা কখনই গলা ফাটিয়ে নিজেদের আদিবাসী দাবি করেনা। যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে তারাই নিজেদের আদিবাসী দাবি করে নিজেদের শেকড় গাড়তে চায়। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে উপজাতি সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতে‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধানের কোথাও ‘আদিবাসী’ শব্দের স্বীকৃতি নেই। তাই যে শব্দটা সংবিধান গ্রহন করে না, সেই শব্দ ব্যবহার বন্ধ করেন।’
মুবতাসিম ফুয়াদ নামে একজন লিখেছেন, ‘আদিবাসী’ শব্দটা ভীষণভাবে রাজনৈতিক। যাদের টুকটাক জানাশুনা আছে এ ব্যাপারে তারা সবাই খুব ভালভাবেই জ্ঞাত। আর আমি, আপনি সকলেই বাংলাদেশি। এটাই বড় পরিচয়। আপনাদের সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাসে স্বকীয়তা আছে। তার ব্যাপারে আমরা শ্রদ্ধাশীল। তবে এ ভূখন্ড নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করলে সে যে ই হোকনা কেন; বাঙ্গালী বা অবাঙালি, তা বরদাশ করা হবেনা। সরকারকে সাধুবাদ জানাই এমন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ায়। পৃথিবীর সকলেই ভাল থাকুক, আপনিও ভাল থাকুন।’
এদিকে, কিছু ব্যক্তিকে ‘আদিবাসী’ বিষয়ক প্রজ্ঞাপনটি নিয়ে ফেসবুকে বিভ্রান্ত ও মিথ্যাচার করতে দেখা গেছে। এসব বিভ্রান্তির জবাবে কড়া জবাব দিয়েছেন দেশপ্রেমী নেটাগরিকরা।
প্রজ্ঞাপনের সমালোচকদের একজন আহমেদ আমান মাসুদ লিখেছেন, ‘যতদূর জানি পঞ্চদশ সংশোধনী বিলে ২৩ক নামে সংস্কৃতি সংক্রান্ত একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে শুধুমাত্র। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপ-জাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
‘আদিবাসী’ শব্দের পরিবর্তে সেখানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং নৃ-গোষ্ঠী শব্দ তিনটি যোগ করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের কোথাও এটা উল্লেখ করা হয়েছে কি যে, এখন থেকে আর ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, করলে সেটা সংবিধান অবমাননা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য করা হবে? বিষয়টি পরিস্কার না করা পর্যন্ত টকশো কিংবা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশ দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আপাতত স্বস্তির বিষয় এটুকুই, সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে এখনো নজর দেয় নাই।’’
জবাবে আব্দুর রোউফ রুবেল লিখেছেন, ‘তাহলে বাঙালিরা বাংলাদেশে কি উড়ে এসেছে। আদিবাসীর সংজ্ঞায় আপনারা পড়েন না। কেন মিথ্যা দাবি করেন? পুরো বাংলাদেশ হিসেব করলে বাঙ্গালি সহ সাওতাল, কোল, মুন্ডা প্রভৃতি হল আদিবাসী। আর শুধুমাত্র পার্বত্যচট্টগ্রাম হিসেব করলে সেখানে কেউই আদিবাসী না। সব জাতিগোষ্ঠীই সেখানে বহিরাগত। কেউ আগে, আর কেউ পরে এসেছে।’
‘আদিবাসী’ শব্দটি কেউ চাইলেই নিজের মন মত ব্যবহার করতে পারে না। এর সংজ্ঞা আছে, বৈশিষ্ট্য আছে। এর আওতায় আপনারা নন। আপনি চাকমা, মারমা প্রভৃতি জাতি নামে, এই পরিচয়ে কেন সন্তুষ্ট নন?’
আদিবাসী বিতর্ক নিয়ে আরেক জন লিখেছেন, ‘আদিবাসী শব্দটার ব্যাপকতা অনেক। বাংলাদেশে যে সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অল্পকিছুকাল আগেই পার্শ্ববর্তী বা দূরবর্তী এলাকা থেকে এ অঞ্চলের পাহাড় জঙ্গল কেটে বসবাস করছে তারা আসলে ওই অর্থে আদিবাসী নয়। অনেককে তো ব্রিটিশরাও নিজেদের সুবিধার্থে অন্য অঞ্চল থেকে এইদেশে নিয়ে এসেছে । তাই আদিবাসী বিতর্কে না যেয়ে নিজেদেরকে বাংলাদেশি জাতিসত্তা হিসেবে পরিচয় দেয়াই ভাল।’