অন্তঃদ্বন্দ্বে রক্তাক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম

kk

ড. মাহফুজ পারভেজ

 সাত দিনে পাঁচ খুন। বছরে ৪০ জন। দেড় যুগে নিহত ছয় শতাধিক। অন্তঃদ্বন্দ্বে রক্তাক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম। অগ্নিগর্ভের উত্তপ্ত লাভাস্রোতে পুড়ছে পাহাড়ের মানুষ ও রাজনীতি। পাহাড়িদের তিন উপদলের আদর্শিক মতপাথর্ক্যের ফলে সৃষ্ট সশস্ত্র সংঘাতে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। কেবল খাগড়াছড়িতেই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২৯শে জুন থেকে ৫ই জুলাই পর্যন্ত ৫জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে সন্তু লারমা  
সমর্থিত জেএসএসের একজন, এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএসের তিনজন এবং ইউপিডিএফ সমর্থিত একজন। ২৯শে জুন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএসের উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমন চাকমা (৪০)। ২রা জুলাই দীঘিনালা উপজেলায় খুন হন এমএন লারমা সমর্থিত যুব সমিতির সদস্য মিতন চাকমা (৪০)। ৪ঠা জুলাই পানছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ সমর্থিত সমীরণ চাকমা (৩৫) এবং এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএসের সদস্য জার্মান চাকমা (২৭)। ৫ই জুলাই মানিকছড়ি উপজেলায় খুন হন সন্তু লারমা সমর্থিত জেএসএস সদস্য উমং মারমা (৫০)। এদিকে, রাঙ্গামাটির সমাবেশ থেকে ফেরার পথে গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি লংগদু উপজেলার কাট্টলি এলাকা হতে অপহরণের শিকার সন্তু পক্ষের ৫২ জন নেতাকর্মীকে এখনও মুক্তি দেয়া হয়নি। পাহাড়িদের অন্তঃকোন্দলের সঙ্গে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘাতে হতাহতের তথ্য যুক্ত করা হলে এ সংখ্যা তিনগুণ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

 
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, শান্তিচুক্তির (১৯৯৭) পর গত ১৫ বছরে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ক্ষমতার লড়াইয়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কমপক্ষে ৬০০ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। আহত ও অপহরণের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। নিহতের তালিকায় চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের ২৫৯ জন, সন্তু লারমা সমর্থিত জেএসএসের ৩০০ জন এবং এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএসের ৩২ জন নেতাকর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা শান্তিবাহিনীর ৮৪ জন সদস্যও রয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষণায় নিয়োজিত বিশেষজ্ঞরা জানান, শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় পাহাড়িদের মধ্যে ক্ষমতা বিস্তারের নতুন ধারা। শান্তিচুক্তির পক্ষে সন্তু লারমা সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং চুক্তির বিপক্ষে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এখন রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত। এরই মাঝে নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে দ্বিধাবিভক্ত হয় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিজেএসএস)। বিচ্ছিন্ন গ্রুপটি ২০১০ সালের ১০ই ডিসেম্বর সাবেক গেরিলা নেতা সুধাসিন্দু খীসা ও মেজর পেলের নেতৃত্বে গঠন করে পাহাড়ের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এই গ্রুপ পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে অটল। চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ ও এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএসের মধ্যে নেতৃত্বগত কারণে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিচুক্তিপন্থি জেএসএসকে  প্রতিহত করতে এই দুই সংগঠনের মধ্যে কার্যকর হয়েছে অলিখিত রাজনৈতিক ঐক্য। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত ও দুর্গম জনপদে শান্তিচুক্তির আগের মতোই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

বিভিন্ন উপদলের পারস্পরিক লড়াই, আদর্শিক টানাপড়েন, ক্ষমতা বিস্তার, চাঁদাবাজি ইত্যাদিতে নিরীহ পাহাড়িদের জনজীবন অতিষ্ঠ। উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ের একক ও শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এখন আদর্শ-নেতৃত্ব এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে তিন ভাগে বিভক্ত। তিন গ্রুপে বিভক্ত পাহাড়িদের আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যেই চলছে অঘোষিত সশস্ত্র যুদ্ধাবস্থা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা মনে করেন, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। একমাত্র ক্ষমতার রাজনীতির কারণেই চলছে এই পাল্টা-পাল্টি হত্যা। শান্তি বার বার পরাজিত হচ্ছে সন্ত্রাসের কাছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির অবনতির জন্য একটি পক্ষ শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়াকেই দায়ী করেছে। তাদের মতে, যথাসময়ে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের জন্ম। অনেকেই মনে করেন, পাহাড়ের জনগণ এখন শান্তিচুক্তির পক্ষে এবং বিপক্ষে স্পষ্টতই বিভক্ত।

পার্বত্য বাঙালিরা আগে থেকেই শান্তিচুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন পাহাড়িদের শান্তিচুক্তি-বিরোধী গ্রুপ। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির পক্ষের চেয়ে বিপক্ষের জনসমর্থনই বেশি। পুরো পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের গড়িমসি ও দোদুল্যমানতা। ১৫ বছরে শান্তিচুক্তির বিশেষ কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি এবং চুক্তির যেসব ধারার ব্যাপারে পাহাড়ি ও পার্বত্য বাঙালিদের মধ্যে আপত্তি রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কেও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মত-পার্থক্য দূর করার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন’ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের জন্য গৃহীত উদ্যোগ খুবই শ্লথ। সমপ্রতি সরকার পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে সংশোধনী আনার জন্য জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপন করে। এই বিল মন্ত্রিপরিষদ সভায় নীতিগত অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই পার্বত্য এলাকার বাঙালি নেতৃবৃন্দ এই সংশোধনী বাতিল বা পুনর্বিবেচনার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। তাদের বক্তব্য, সংসদে উত্থাপিত আঙ্গিকে এই আইন সংশোধন করা হলে পার্বত্য এলাকার বাঙালিরা ভূমিহারা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে সংশোধনীর ওপর পাহাড়িদের পক্ষেও আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে।

সন্তু লারমা নিজেই সামপ্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে ‘আনীত সংশোধনীতে তাদের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি’ মর্মে মন্তব্য করে সেখানে আরও পাঁচটি বিষয় সংযোজন-বিয়োজনের দাবি জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, সরকারের সঙ্গে তাদের ১৩টি সংশোধনী আনার বিষয়ে ঐকমত্য হলেও ১০টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সন্তু লারমা স্পষ্ট করে এ-ও বলেছেন, তাদের দাবির প্রতিফলন না হলে ভূমি কমিশন নিয়ে এতদিনের অচলাবস্থায় কোন পরিবর্তন হবে না। শান্তিচুক্তি বিরোধী পাহাড়ি গ্রুপগুলোও ভূমি কমিশনের ব্যাপারে নানা আপত্তির কথা জানিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কট ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে পাহাড়ি গ্রুপগুলো এবং পার্বত্য বাঙালিদের মধ্যে সংঘাতপূর্ণভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত সংঘাতের সম্ভাব্য পরিণতি শান্তিচুক্তির পূর্বের চেয়েও ভয়াবহ ও রক্তাক্ত আকার ধারণ করবে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সৌজন্যে: দৈনিক মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন