উপজেলা নির্বাচন: প্রেক্ষিত রাঙামাটি সদর ও দিঘীনালা: তবে কি ইউপিডিএফ জেএসএস বিরোধীতা লোক দেখানো

bd%7Dup

মো. আল আমিন:

সদ্য সমাপ্ত খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা নির্বাচন শেষে একটি প্রশ্নই নির্বাচন বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। নতুন সমীকরণ তৈরী করে নির্বাচনী সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগি করে নিয়েছে ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী’ পাহাড়ের দুই সশস্ত্র আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি। দীর্ঘ বহু বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক শাখা জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বাংলাদেশ সরকার। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী পাশ কাটিয়ে ভিন্ন কায়দায় নিজেদের দাবী ঠিকই সেবার আদায় করে নিয়েছিল সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী। কিন্তু বাঁধ সাধে জনসংহতির আরেক গ্রুপ। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী থেকে সরে না এসে তারা চুক্তির বিরোধীতা করে সৃষ্টি করে নতুন সংগঠন – ইউপিডিএফ। বর্তমানে এর নেতৃত্বে আছেন প্রসীত বিকাশ খীসা।

প্রথম দিকে বেশ কোণঠাসা থাকলেও, শক্তি সঞ্চয় করে ক্রমেই শক্তিশালী হতে শুরু করে ইউপিডিএফ। বর্তমানে সন্তু গ্রুপকে হটিয়ে খাগড়াছড়ির বেশিরভাগ এলাকা ও রাঙ্গামাটির বিশাল দুর্গম এলাকা তাদের দখলে। এই দখলবাজী কতটা জাতির স্বার্থে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারন বর্তমানে সম্পূর্ন চাঁদাবাজি সর্বস্ব এই দুটি দল প্রত্যহ পরস্পরের সাথে রক্তক্ষয়ী স্বশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। চাঁদাবাজি নিয়ে ও এলাকা দখলের নিত্য লড়াইয়ে ভাতৃঘাতি সংঘর্ষের খবর বহুবার শুনতে হয়েছে পাহাড়ের মানুষকে। এমনকি সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়েই দীঘিনালার বাবুছড়া ইউনিয়নে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন মিনু চাকমা ও সুদৃষ্টি চাকমা নামের দুজন ইউপিডিএফ কর্মী। ইউপিডিএফ এর দাবীতে ও নিহতদের পরিবারের দায়ী করা মামলায় খুনীদের শন্তু লারমার জেএসএস-এর কর্মী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এরই মাঝে সন্তু গ্রুপের বিরোধীতা করে জনসংহতি সমিতিতেই তৈরী হয়ে যায় নতুন ভাঙ্গনের। জেএসএস (এম এন লারমা) নামের নতুন গ্রুপের জন্ম হয়েছে সন্তু লারমার একক নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষিপ্ত সংস্কারপন্থীদের দ্বারা। কৌশলগত স্বার্থে এই নতুন গ্রুপকে পরিচর্যা করতে থাকে শন্তু গ্রুপের পূর্ব শত্রু ইউপিডিএফ। শত্রুর শত্রু- মিত্র নীততে একে অপরকে এতদিন ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ সহযোগীতাও করে তারা। কিন্তু সেই চিত্রও পালটে যায় এবারের নির্বাচনে।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাচনে ৬ জন উপজাতি ও তিন জন বাঙালি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৬ জন উপজাতি প্রার্থীর মধ্যে নবকমল চাকমা ও চয়ন বিকাশ চাকমা ছিলেন যথাক্রমে ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত। দীঘিনালায় তাদেরই শক্ত অবস্থান হওয়ায় এখানে কয়েকবছর ধরে কোন নির্বাচনের প্রার্থী দিচ্ছে না জেএসএস (শন্তু) গ্রুপ। গত উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন সংস্কারপন্থী জেএসএস সমর্থিত ধর্মবীর চাকমা, হেরে গিয়েছিলেন ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রিয়দর্শী চাকমা। কিন্তু এবার বিজয়ী হন ইউপিডিএফ সমর্থিত নবকমল চাকমা, হেরে গেছেন জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত চয়নবিকাশ চাকমা।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর অনুযায়ী, ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থীর জয়ের মূলে রয়েছে ইউপিডিএফ-এর সাথে তাদেরই ‘চিরশত্রু’ জেএসএস (শন্তু) এর সমঝোতা! নির্বাচনী ফলাফল পর্যবেক্ষনের পরও মিলেছে খবরের সত্যতা। তবে ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সন্তু) কেউই রাজী নয় এই খবরের সত্যতা স্বীকার করতে।

বস্তুত হিসাবটা এলাকা ও ভোটার সংখ্যার। দীঘিনালায় সন্তু গ্রুপের অবস্থান সক্ত না হলেও, দীঘিনালার বাবুছড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী নাড়াইছড়ি এবং নুনছড়ি ও জারুলছড়িতে অবস্থিত কেন্দ্র সমূহ ও ভোটারদের উপর রয়েছে সন্তু গ্রুপের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। বিপরীত অবস্থা রাঙ্গামাটি সদরে। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় শন্তু গ্রুপের একক নিয়ন্ত্রন থাকলেও, সদর উপজেলার কুতুবছড়ি, সাপছড়ি ও বন্দুকভাঙ্গা এলাকায় সম্পূর্ন আধিপত্য ইউপিডিএফ-এর। দুই উপজেলায়ই একই সাথে নির্বাচন হওয়ায়, দুই শত্রু নির্বাচনী সখ্যতা তৈরী করে একে অপরের সাথে। রাঙ্গামাটি সদরে জেএসএস (শন্তু গ্রুপ) এর প্রার্থীকে নিজেদের আওতাধীন তিন ইউনিয়নের ভোট পাইয়ে দেয়ার নিশ্চয়তার বিনিময়ে, দীঘিনালার তিনটি কেন্দ্রের ভোট সন্তু গ্রুপ থেকে নিজেদের প্রার্থীদের পক্ষে আদায় করে নেয় ইউপিডিএফ।

গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও ইউপিডিএফ এর সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কুজেন্দ্র লাল জিতলেও তার নিজের এলাকা দীঘিনালায় বেশি ভোট পেয়েছেন প্রসীত খীসা। আবার প্রসীত খীসা দীঘিনালায় সামগ্রিকভাবে বেশি ভোট পেলেও, জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন বাবুছড়ার নাড়াইছড়ি, জারুলছড়ি ও নুনছড়িতে নামেমাত্র ভোট পেয়েছেন। ইউপিডিএফ-কে সমর্থন না দিয়ে সেবার আওয়ামী লীগের কুজেন্দ্রলালকে সমর্থন দিয়েছিল জেএসএস (সন্তু)। নাড়াইছড়ি কেন্দ্রে ইউপিডিএফ সভাপতি মাত্র ৫৯ ভোট পেলেও, কুজেন্দ্রলাল পেয়েছিলেন ১০৪২ ভোট!

কিন্তু এবার নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ায় জেএসএস’র (সন্তু) সমর্থনের ফলে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী নব কমল চাকমা সেই একই কেন্দ্রে পেয়েছেন ১০৪৭ ভোট, আর সেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত আলহাজ্ব কাশেম পেয়েছেন মাত্র ১১ ভোট, সংস্কারপন্থী জেএসএস সমর্থিত চয়নবিকাশ পেয়েছেন মাত্র ২৪ ভোট! একই চিত্র জারুলছড়ি ও নুনছড়ি কেন্দ্রেও! এই তিনটি কেন্দ্র মিলিয়ে ইউপিডিএফ সমর্থিত নবকমল পেয়েছেন প্রায় ৩, ৩১৬ ভোট, আওয়ামী লীগ সমর্থিত আলহাজ্ব কাশেম পেয়েছেন ৪৭ ভোট, জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত চয়নবিকাশ পেয়েছেন সাকূল্যে ১৫৫ ভোট। যদিও নবকমল চাকমার ১২, ৮১২ ভোটের বিপরীতে আলহাজ্ব কাশেম ১০, ৪৫৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন, জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত চয়নবিকাশ পেয়েছেন ৯, ৭৫৮ ভোট। একই অবস্থা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর বেলায়ও।

গতবার হেরে যাওয়া ইউপিডিএফ সমর্থিত সুসময় চাকমা এবার এই তিনটি কেন্দ্রের একচেটিয়া ভোট নিজের দখলে নিয়ে জয় দখল করেছেন। গতবারের ভাইস চেয়ারম্যান জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত সুপ্রিয় চাকমা এবার হেরেছেন নতুন সমীকরনের গ্যাঁড়াকলে।

চিরশত্রু ইউপিডিএফ’কে এই সমর্থনের বিনিময়ে জেএসএস (সন্তু) পেয়েছে আরও বড় সুবিধা! রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা নির্বাচনে ইউপিডিএফ কোন প্রার্থী দেয়নি এবং নিজেদের অধীনে থাকা ইউনিয়ন তিনটির ভোট একচেটিয়া পেয়েছে জেএসএস (সন্তু) সমর্থিত প্রার্থী অরুণ কান্তি চাকমা। সাপছড়ি, কুতুবছড়ি ও বন্দুকভাঙ্গা এলাকার বিপুল ভোট পেয়ে সহজেই জয় পেয়েছেন অরুণ কান্তি চাকমা। অথচ গতবার নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মুছা মাতব্বর।

ইউপিডিএফ ও জেএসএস (শন্তু) উভয়ই অস্বীকার করেছে কোন ধরণের নির্বাচনী সমঝোতার। ইউপিডিএফ-এর দীঘিনালা উপজেলা সংগঠক কিশোর ত্রিপুরা ও জেএসএস (সন্তু) এর সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা উভয়েই উড়িয়ে দিয়েছেন সমঝোতার খবর। সমঝোতার পর অস্বীকার – এমন লুকোচুরি লুকোচুরি গল্পের পর প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি ইউপিডিএফ আর সন্তু গ্রুপের বিরোধীতা লোক দেখানো? নির্বাচনে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের বেলায় তারা এক হতে পারলেও, নিজেদের মধ্যে ভাতৃঘাতি লড়াই বন্ধ করতে তারা এক হতে পারে না বলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে সাধারন পাহাড়িদের মনে। বরং এ লড়াইকে জিইয়ে রেখে এলাকায় আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রেখে চাঁদাবাজি দখলদারিত্ব বজায় রাখতেই যেন তারা অধিক আগ্রহী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন