এবার বিয়ের পিঁড়িতে দুই হাত হারানো অদম্য রায়হান

fec-image

ইচ্ছা শক্তি, সাহস ও উদ্যম থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতা বাধা হতে পারে না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স করা শারীরিক প্রতিবন্ধী অদম্য বাহার উদ্দিন রায়হান এবার বসেছেন বিয়ের পিঁড়িতে। যা ছিল কল্পনাতীত। ইচ্ছে শক্তি, সাহস ও উদ্যম থাকলে কোন প্রতিবন্ধকতা বাঁধা হতে পারে না। রায়হান মুখ দিয়ে লিখেই শুধু সফল না, সে জীবন যুদ্ধেও আজ সফল। দুই হাত নেই, তবু অদম্য রায়হান তার জীবন যুদ্ধের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার খাতায় মুখে কলম ধরে লিখে একের পর এক ভালো ফলাফল করে অসাধারণ কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। ঠিক তেমনি তার জীবন চলার পথেও নতুন জীবন সঙ্গীকে নিয়েও সফল হবেন এমনটা প্রত্যাশা দেশবাসীর। দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা ও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এই অদম্য রায়হান।

মানুষের কল্পনারও বাহিরে ছিল কেউ তাঁর ঘরনি বা জীবন সঙ্গী হবে। কিন্তু রায়হান সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে সবাইকে চমকিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। জীবন যুদ্ধে হারনামা শৈশবে দুই হাত হারানো অদম্য তরুণ বাহার উদ্দিন রায়হানকে সরকারের আইসিটি বিভাগের “এনহান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (EDGE) প্রকল্পের” অধীনে ১ লাখ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানে তাঁকে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে চাকুরী দেয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে প্রয়াস নামক এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অদম্য তরুণ রায়হানকে চাকুরীর নিয়োগপত্র তুলে দেন আইসিটি মন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলক। বর্তমানে তিন মাসের অধিক সময় ধরে তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরিতে কর্মরত রয়েছেন।

শুক্রবার বিকেলে অদম্য বাহার উদ্দিন রায়হান ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়া ছড়া বিমানবন্দর রোড এলাকায় বসবাসকারী মুসলিমা আক্তার সাথে তিনি বিবাহে আবদ্ধ হয়। তিনি ওই এলাকার আলি আকবর ও রাশেদা আক্তারের কন্যা এবং কক্সবাজার সদর উপজেলার বাসিন্দা। চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি ও এলএল এম করেন মুসলিমা। শুক্রবার বিকালে উভয় পরিবারের সম্মতিতেই অদম্য রায়হানের সাথে সাগর কন্যা মুসলিমা আক্তারের বিবাহ ও আকদ সম্পন্ন হয়। আগেই থেকে একজন অপর জনের সাথে সম্পর্ক এবং পরিচিত ছিল।

চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের জহির পাড়ায় অদম্য বাহার উদ্দিন রায়হানের বাড়ি। শিশু বয়সেই বাবা বশির আহমদকে হারাতে হয়। তাঁর আপনজন বলতে আছেন শুধুই মা খালেদা বেগম। বাড়িতে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিল সে। সেখান থেকে যা আয় হতো তা দিয়েই তাঁর পড়ালেখা আর সংসার চলতো। পাশাপাশি মা খালেদা বেগম বাড়িতে আয়বর্ধকমূলক কাজ করতেন। দুই হাত না থাকার পরও অদম্য রায়হান প্রতিটি পরীক্ষায় যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তা অবিশ্বাস্য। শুধু তাই নয়, খেলাধুলাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন তিনি।

এদিকে, অদম্য রায়হান বিযের পিঁডিতে বসার খবর জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দু’দিন ধরে অভিনন্দন বার্তায় ঝড় উঠে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তাকে ঘিরে নবদম্পতি ছবিসহ ফেসবুকে বিভিন্ন ভালো ভালো মন্তব্য লিখে পোস্ট করেন। সাহস ও উদ্যম থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতা বাধা হতে পারে না, তা তরুণ প্রজন্মের কাছে আবারো প্রমাণ করেছে অদম্য রায়হান।

জানা গেছে, একটি অনুপ্রেরণার নাম বাহার উদ্দিন রায়হান। ২০০৪ সালে রায়হান তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। ওইদিন সন্ধ্যায বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে ঢুকে পড়া একটি চড়ুই পাখিকে বাঁচাতে গিয়ে ঝলসে যায় তাঁর হাত ও পায়ের তালু। দীর্ঘ চিকিৎসার পর কেটে ফেলতে হয় তাঁর দুই হাত। এতে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান বাহার উদ্দিন রায়হান। তবু পড়ালেখা থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হয়নি তিনি। প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি, মনোবল আর সাহস ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। হাত না থাকলেও মুখ দিয়ে লিখে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। রায়হান চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।

চকরিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি। সে এইচএসসি পাস করার পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলও করেছেন তিনি। রায়হানের স্বপ্ন ছিল, পড়াশোনা শেষ করে একটি ভালো চাকরি। সবাই মনে করেছিলেন দুই হাত হারানোর পর রায়হান আর পড়ালেখা করতে পারবে না। কিন্তু মানুষের সেই ভাবনা দূরে ঠেলে দিয়ে অদম্য রায়হান সামনেই এগিয়ে আজ জীবন যুদ্ধে সত্যি জয়ী হয়েছেন। এরই মধ্যে রাযহান সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তাঁর এই সাফল্য ও কৃতিত্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দু’দিন ধরে অভিনন্দন বার্তায় ঝড় উঠেছিল। সাহস ও উদ্যম থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতা বাধা হতে পারে না, তা আরেকবার তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রমাণ করলো এই অদম্য রায়হান।

রায়হান সম্পর্কে সদ্যবিবাহিত স্ত্রী মুসলিমা আক্তার বলেন, পূর্বে থেকেই একজন অপর জনকে চিনি। সে যখন ভার্সিটিতে পড়তো, তখন ওর সাথে আমার ফেসবুকে কথা হতো। একটা সময় বুঝতে পারি ও পড়াশুনায় অনেক ভালো করছে। তবে ওর ফ্যামিলি লাইফ বা সামনের দিকে আগানোর কোনো চিন্তা-চেতনা ছিলো না। ওর হাত নেই এটা আমার কাছে কোনো সমস্যা মনে হয়নি। একটা লোকের হাত নেই, তাই সে বিয়ে করতে পারবে না, তার ফ্যামিলি হবে না, এমনটা হতে পারে না এবং এমন চিন্তা আমারও নেই। আমি ওকে স্বপ্ন দেখাই এবং আমি ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানাই। সর্বশেষ আমরা বিয়েও করেছি। আমরা সামনের দিনে যেন ভালো থাকতে পারি তার জন্য সকলেই দোয়া করবেন।

বিয়ে প্রসঙ্গে অদম্য বাহার উদ্দিন রায়হান বলেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর মানসিকতা ঠিক থাকলে প্রতিবন্ধকতা কোনো বিষয় নয়। আমাদের বিয়েটা দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে মনে করি। এই পর্যন্ত পৌঁছাতে সকলেরই আন্তরিকতা পেয়েছি। স্কুল জীবন থেকে কর্মজীবনে যোগদেয়া পর্যন্ত যারা আমার সাথে ছিলেন তারা কেউ বুঝতে দেননি আমার দুটো হাত নেই। যার মেন্টালিটি ভালো তিনি এগিয়ে আসবেন। কারো ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। সকলে আমাদের জন্য দোয়া করবেন যাতে আগামীর দিন গুলোতে আমরা ভালো থাকতে পারি, দেশের মানুষের কল্যাণে ভালো কিছু করতে পারি। আমার অনেকদূর যেতে হবে, অনেক কিছু করার আছে, আপনাদের দোয়া চাই। আমার বিশ্বাস আমার দেশের মানুষ আমার পাশে থাকবে, আমাকে অনুপ্রাণিত করবে। সকলের জন্য ভালোবাসা রইলো।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বিয়ে
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন