পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিদেশীয় সীমান্ত

কুকি-চিন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন দমনে চিরুনি অভিযান

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তে হঠাৎ মাথাচারা দেয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) দমনে ত্রিদেশীয় চিরুনি অভিযান পরিচালনা হতে পারে বলে জানা গেছে।

পার্বত্য এলাকার বান্দরবান ও রাঙামাটির সীমান্ত এলাকা নিয়ে কল্পিত কুকিল্যান্ড ঘিরে সম্প্রতি অপহরণ-খুন-মুক্তিপণ আদায় এবং জঙ্গি কর্যিক্রম চালাচ্ছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামের সংগঠনটি। গোয়েন্দারা বলছেন- কুকি-চিনের বেশ কিছু সদস্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়ে আত্মগোপন করেছে। একটি অংশ প্রতিবেশী মিয়ানমার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায়ও অবস্থান নিয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে ত্রিদেশীয় চিরুনি অভিযান পরিচালনা পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।

তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের নয়াদিল্লিতে চলমান বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৩তম সীমান্ত সম্মেলনে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। সম্মেলনে আলোচনাটি অত্যন্ত গুরুত্ব পায় বলেও জানা গেছে।

বুধবার (১৪ জুন) আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনটি শেষ হবে। আগামীকাল বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদরদপ্তরে মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সম্মেলনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানাবেন। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন মহাপরিচালক সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছেন। সেখানে তিনি দুই দেশের ৫৩তম সীমান্ত সম্মেলনের বিস্তারিত জানাবেন।

এদিকে দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে বর্তমানে পার্বত্য এলাকার বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির একাংশের নতুন আতঙ্কের নাম বিচ্ছিন্নবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ। সংগঠনটি ২০১৮ সালে কল্পিত মানচিত্র ও মুদ্রা পাকাশ করে অস্তিত্ব জানান দেয়। সেই সঙ্গে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) গঠন করে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা, খুন-গুম-অপহরণ করে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে স্থানীয়রা। এমনকি সংগঠনটি দেশের নব্য জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে কৌশলগত জোট বেঁধে দুর্গম পাহাড়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালায়। বিষয়টি র‌্যাবের গোয়েন্দা তথ্যে বেরিয়ে এলে সেনা-বিজিবির সহায়তায় অভিযান চালায় সংস্থাটি। এরপর সেনা বাহিনীও দফায় দফায় অভিযান চালায়।

সূত্রমতে, কেএনএফ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও রাঙামাটির একাংশকেন্দ্রিক আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক আয়তনের লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি ও বরকলসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে কেএনএফ। প্রস্তাবিত মানচিত্রের তিন দিকে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত।

পাহাড়ের বম, পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং নামক ক্ষুদ্র ছয়টি জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। সংগঠনের লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৮ সাল বলে উল্লেখ থাকলেও মূলত ২০১৮ সালের পর থেকে সশস্ত্র কাঠামোয় মাথাচাড়া দিতে থাকে সংগঠনটি।

সবশেষ গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে কুকি-চিনের ভয়ঙ্কর রূপ জনসমক্ষে আসে। এই সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের থানচি সড়ক নির্মাণের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে গত ১১ মার্চ ১২ শ্রমিককে অপহরণ করে। এদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। এছাড়া সাত শ্রমিককে মুক্তিপণের বিনিময়ে ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সড়ক নির্মাণ কাজে আর না যাওয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়। বাকি চার শ্রমিককে এখনো কেএনএ জিম্মি করে রেখেছে বলে জানা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় পরের দিন ১২ মার্চ দুপুরে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে নাজিম উদ্দিন নামে টহলরত সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে (মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার) হত্যা এবং দুজনকে আহত করে কুকি সন্ত্রাসীরা। তার আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের ৩ উপজেলায় ‘কেএনএফ’ গাড়ি চলাচল বন্ধের জন্য পরিবহন মালিক সমিতিকে হুমকি দিয়ে নোটিশ জারি করে। যার মূল উদ্দেশ্য বান্দরবানকে পর্যটকশূন্য করা।

চলাচল বন্ধের জন্য পরিবহন মালিক সমিতিকে হুমকি দিয়ে নোটিশ জারি করে। যার মূল উদ্দেশ্য বান্দরবানকে পর্যটকশূন্য করা। গত ১৭ মে বুধবার সেনাবাহিনীর অপর একটি টহল দল হামলার শিকার হয়। এতে ২ সেনা সদস্য শহীদ হন। এ ঘটনার পর সম্প্রতি কুকি-চিনের পেতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণে আরো এক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এরপর সাড়াশি অভিযানে কুকি-চিনের প্রশিক্ষণ শিবির দখলে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পরে বান্দরবান সফর করেন সেনাপ্রধান। এ সময় তিনি পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেন

জানা গেছে, পার্বত্যাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিনের বেশ কিছু সদস্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়ে আত্মগোপন করেছে। বান্দরবান ও রাঙামাটির সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে টিকতে না পেরে তারা পাশে মিজোরাম রাজ্যে আত্মগোপন করে। বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে মিজোরামের গভীর পাহাড়ি জঙ্গলে কুকি-চিনের ঘাঁটিও রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কুকি-চিনকে দমন করতে ভারতের বিএসএফের সহায়তা চাইছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তার ধারাবাহিকতায় ৫৩তম বিজিবি-বিএসএফ সম্মেলনে বিষয়টি স্থান পায়। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে এই বিষয়টি বিজিবির পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয় বলেও জানা গেছে।

বিজিবির একটি সূত্র জানায়, বৈঠকে আত্মগোপন করা সন্ত্রাসীদের একটি তালিকাও বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এদের ধরিয়ে দিতে বিএসএফের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তালিকায় মাদক ব্যবসায়ী, চোরকারবারি এবং আরাকান কেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান আর্মি, বান্দরবান-রাঙামাটি কেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিনের ক্যাডার বাহিনীর নাম রয়েছে। কুকি-চিনের আত্মগোপন করা প্রধান নেতা নাথান বমের নামও রয়েছে ওই তালিকায়।

বিজিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের মাটি সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে পাহাড়ে পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে বিজিবিও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অভিযানে অংশ নিচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন আমাদের সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। যেভাবেই হোক সেনাবাহিনী এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় দুই দেশের মধ্যে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যাবে। ভারতের নয়াদিল্লিস্থ বিএসএফ চাওলা ক্যাম্পে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৩তম সীমান্ত সম্মেলনে দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে আলোচ্যসূচিতে সীমান্ত এলাকায় নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করা, আহত করা এবং হত্যা করার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কুকি-চিন, গ্রুপ, চিরুনি অভিযান
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন