চাকমা বিদ্বেষ–ই নাথান বমকে বিদ্রোহী করে তোলে

fec-image

নাথানের জেএসএস ও আঞ্চলিক পরিষদের বিরোধীতার পেছেনও চাকমা বিদ্বেষ কাজ করেছে। কেননা এসব জায়গায়ও চাকমাদের আধিপত্য রয়েছে। নাথান মূলত চাকমাদের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতেই দাবি গুলো সাজিয়েছিলেন। আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস এবং চাকমাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার কেএনএফ প্রকাশ্যেই করেছে। তবে এও ঠিক চাকমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পাহাড়ে নতুন নয়।

ইনডিপেনডেন্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাহাড়ে ম্রো জনগোষ্ঠির একটি অংশ ‘গরম বাহিনী’ গড়ে তোলে। এরপর মগ পার্টি নামে একটি সংগঠনও গড়ে ওঠে বান্দরবানে। অবশ্য এরা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। এখানে এখন কেএনএফ প্রভাব রেখেছে।

পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর মধ্যে যারা সব দিক থেকেই পিছিয়ে আছে তাদের মধ্যে বম সম্প্রদায় একটি। এদের আবাসস্থলও বেশ গহীনে। মূলত বান্দরবানের থানচি ও রুমা উপজেলায় বম সম্প্রদায়ের মানুষের দেখা বেশি পাওয়া যায়। তারপরও তাদের সংখ্যা ৫ থেকে ৬ হাজারের বেশি নয়।

এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই সম্প্রদায়ের একজন, নাথান বম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে (এখন চারুকলা অনুষদ) পড়াশুনার সুযোগ পেয়ে গেল তখন তা নিয়ে বম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে গর্বের কমতি ছিল না। সেই নাথানই এখন বম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য বিপদ ডেকে এনেছেন। বেশির ভাগ বম মানুষ নাথানের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, তাদের দেখা হচ্ছে সন্দেহের চোখে। কেননা নাথান বম পাহাড়ে গড়ে তুলেছেন সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল কুকি–চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এদের সশস্ত্র শাখা কুকি–চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) পাহাড়ে এক আতংকের নাম। হঠাৎ পাহাড় অশান্তের পেছনে এই সংগঠনটিকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের একজন নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, নাথান যখন ঢাকা থেকে এলাকায় আসতেন তখন তাদের সম্প্রদায়ের অনেকেই এসে তার সঙ্গে কথা বলতেন। নাথানের মধ্যে ‘নেতানেতা’ একটা ভাবও তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া নাথান পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের স্থানীয় নেতা ছিলেন। চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগে পড়াশুনা করতেন নাথান। বিভিন্ন সময় এলাকায় বিভিন্ন জনের ভাস্কর্য তৈরি করে পরিচিতও পেয়েছিলেন। বিশেষ করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির প্রধান মানবেন্দ্র দেব লারমার (সন্তু লারমা) ভাস্কর্য করে নাথানের পরিচিতি আরও বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘নাথানের মধ্যে উচ্চাশা তৈরি হতে থাকে। কিন্তু কিছু করতে গেলেই তাকে চাকমা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়তে হচ্ছিল। যে কোনো কারণেই হোক এই প্রতিযোগিতায় নাথান টিকতে পারছিল না। ফলে নাথানের রাগ বা ক্ষোভ গিয়ে পড়তে থাকে চাকমাদের ওপর। এই ক্ষোভ থেকেই নাথান পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কেননা এটা জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। আর চাকমারাই মূলত এর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন।’

নাথানের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরপর নাথান এনজিও প্রতিষ্ঠা, ব্যবসা অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। আমি যেহেতু ঢাকায় কাজ করি তাই আর যোগাযোগটা তেমন ছিল না। তাছাড়া নাথানের চেয়ে আমি বয়সে বড়। এ কারণে আমরা ঠিক বন্ধু ছিলাম না। তবে নাথান সব সময় মনে করতো, তাকে অনেক কিছুই চাকমাদের আধিপত্যের কারণে হারাতে হয়েছে।’

অবশ্য এই ব্যক্তি এ কথাকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। কেননা নাথানের মতো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অনেকেই মনে করেন চাকমা এবং মারমারা সব সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে। এ কারণে অন্য আরও অন্তত ৯টি জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

নাথান বম জাতিসংঘের একটি সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর এই সংস্থাটি পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য কাজ করছিল। চারুকলা থেকে পড়াশুনার পর নাথান সেখানে চাকরির জন্য আবেদন করেন। সেটা ২০০৩ সালের কথা। কিন্তু সেই চাকরিটা তার হয়নি। চাকরিটা পেয়েছিল কয়েকজন চাকমা যুবক। সে সময় নাথানের ধারণা জন্মেছিল কেবল বম সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে এবং চাকমা না হওয়ার কারণে তার চাকরিটা হয়নি।

এরপর সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে নিজের এলাকায় চলে যান নাথান। নামেন পর্যটন ব্যবসায়। একটা রিসোর্ট করেন নিজের এলাকায়। কিন্তু সেই ব্যবসাও বেশিদিন টেকেনি। এরপর ২০০৮ সালে কুকি চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিও গড়ে তোলেন। স্থানীয়দের ধারণা তখন থেকে নাথান অন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল। এনজিও গড়ার পর হয়তো সে কোনো জায়গা থেকে টাকা পেয়েছিল। যা দিতেই সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলেছে।

নাথানের চারুকলার এক বড় ভাই, যিনি নিজেও একজন পাহাড়ি (বম নয়) জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাথান সৌভাগ্যবশত সুযোগ পেয়েছিল। সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পায়নি।

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমেদ একবার বান্দবান গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে সহায়তা দেওয়ার কথা বলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে নাথান সেখানে ভর্তি হন। তবে পড়াশুনায় “গ্যাপ’’ থাকলেও শেষ পর্যন্ত নাথান স্নাতক সম্পন্ন করেন। দেশের বাইরেও পড়াশুনা করেছেন বলে নিজে বলতেন। তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নাথান গিয়েছে, এটা ঠিক। তবে পড়াশুনার বিষয়টি কেউই নিশ্চিত করেননি।’

কেএনএফ শুরুতে পাহাড়ে নতুন রাজ্যের দাবি করে। ৯টি উপজেলা নিয়ে এই রাজ্য গঠনের দাবি তোলে তারা। এক পর্যায়ে তা থেকে সরেও আসে কুকি চিন। নতুন করে দাবি তোলে সায়ত্বশাসিত অঞ্চল করার। দাবির ক্ষেত্রে সংগঠনের অবস্থানের পরিবর্তন হলেও তিনটি বিষয়ে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেগুলো হলো পাহাড়ের প্রথম দল জেএসএস এবং আঞ্চলিক পরিষদ বিরোধিতা আর চাকমা বিদ্বেষ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে তারা এগিয়েও। তিন পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক পদ হলো চিফশিপ এবং হেডম্যান। এদের বেশির ভাগই চাকমা, নয়তো মারমা সম্প্রদায়ের। এ জন্য পাহাড়ে বাঙালি বাদে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং ব্যবসা, এনজিও, প্রশাসনিক সব পদে হয় চাকমা, নয় মারমা জনগোষ্ঠীর লোকজনের প্রাধান্য। এ নিয়ে চাকমা ও মারমা ছাড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোর কিছুটা ক্ষোভও আছে।

কিন্তু বমসহ অন্য জাতিগোষ্ঠির কথা হচ্ছে পাহাড়ে যে আন্দোলন হয়েছে, পাহাড়িদের অধিকারের জন্য যে সংগ্রাম হয়েছে সেটা শুধু চাকমা বা মারমারাই করেনি। পাহাড়ের সবাই করেছে। অথচ সুবিধাগুলো বলা যায় কেবল একটি–দুটি জনগোষ্ঠিই নিয়ে নিচ্ছে। অন্যরা অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।

এই চাকমা বিদ্বেষ থেকে পাহাড়ে ম্রো জনগোষ্ঠির একটি অংশ ‘গরম বাহিনী’ গড়ে তোলে। এরপর মগ পার্টি নামে একটি সংগঠনও গড়ে ওঠে বান্দরবানে। অবশ্য এরা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। এখানে এখন কেএনএফ প্রভাব রেখেছে।

২০২২ সালের শুরুর দিক থেকে ফেসবুকে পাহাড়ের ৯ উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্যের ঘোষণা দেয় কেএনএফ। তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া বার্তায় সমস্ত ক্ষোভ আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস এবং চাকমাদের ওপর চাপায়। বিভিন্ন মহল্লায় হামলা চালিয়ে চাকমাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার নানা বার্তা তারা দিতে থাকে। এরই মধ্যে তারা রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের একটি ত্রিপুরা গ্রামে দুজন জুমচাষিকে হত্যা এবং শিশুসহ কয়েকজনকে আহত করে।

কেএনএফ সুস্পষ্ট দাবি তোলে তাদের স্বায়স্তশাসিত অঞ্চলে পার্বত্য জেলা পরিষদ বা আঞ্চলিক পরিষদের আওতাধীন থাকবে না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে কুকি–চিন তথা বম, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং জনগোষ্ঠীর মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। কিন্তু এই ভূখণ্ডে সরকার ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে বঞ্চনার শিকার তারা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কুকি-চিন, চট্টগ্রাম, বান্দরবান
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন