““স্থানীয় ৩০ থেকে ৩৫টি গ্রামের মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। জুমের চাষাবাদ ঠিক করে করতে পারছে না। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যদের খাবার জন্য তাদের ঘরের খাদ্য ও গৃহপালিত পশুপাখি এমনকি কুকুর পর্যন্ত দিতে হয় তাদের। কখন যে কী হয় বলা খুবই কঠিন। আমাদের ছেলে মেয়েদের ঠিকমত স্কুলের পাঠানো যাচ্ছে না। আমরাও বাজারে নির্ভয়ে যাতায়াত করতে পারছি না।”

কেএনএফ আতঙ্কে স্থবির বান্দরবানের তিন উপজেলা: জনদুর্ভোগ চরমে

fec-image

‘পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা কারণে দুইশত পর্যটক পথ প্রদর্শক, শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট, হাজারো নৌকার মাঝি কর্মসংস্থান হারিয়ে আজ না খেয়ে আছে। পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ২ হাজার পরিবারের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ নানাবিধ সমস্যা জর্জরিত হচ্ছে’

বান্দরবানে থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে এ তিন উপজেলার সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে এ তিন উপজেলার লক্ষাধিক অধিবাসীকে। কেএনএফের ভয়ে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছে।

কেএনএফ সদস্যরা স্থানীয়দের চলাচলের রাস্তায় গাছ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা ও কয়েকটি সেতুর পাটাতন ভেঙ্গে দেয়ার যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে স্থানীয়রা উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও ক্রয় করতে পারছেন। এছাড়া ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ের পাঠানো, অসুস্থ হলে চিকিৎসা জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারছে না। রয়েছে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা। সবমিলিয়ে পাহাড়ের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

সূত্রে জানা যায়, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সংগঠনটি সমতল অঞ্চলের জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এমন খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী গত অক্টোবর থেকে পাহাড়ে অভিযান চালান। অভিযানের সময় থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি তিন উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। বর্তমানও এ নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞার ফলে রুমা উপজেলার ৪নং রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের লুংওয়ের পাড়া, পাইনোওয়াম পাড়া, সলোপি পাড়া, দুলিচাং পাড়া, থামলো পাড়াসহ কয়েকটি পাড়ার বাসিন্দাদের চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ওই সকল গ্রামবাসীর রুমা উপজেলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় কারণে থানচি বাজারে থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে এমনটায় জানায় স্থানীয়রা।

গত ১১ মার্চ বম পাড়া নামক স্থানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা সরকারের উন্নয়ন কাজের শ্রমিকের উপর আতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। এতে দুইজন নির্মাণ শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও ৪ জন শ্রমিক আহত হয়। এছাড়াও ১২ মার্চ একই স্থান থেকে মোট ২১ জন শ্রমিকসহ ঠিকাদারকে অপহরণ করে এবং দুই দিন পর ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া রাস্তায় গাছ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা, সেতুর পাটাতন ভেঙ্গে দেয়াসহ নানা কর্মকাণ্ডের জন্ম দেয় সংগঠনটি। এতে থানচি উপজেলার ২নং তিন্দু ইউনিয়নের ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডসহ ৩০-৩৫টি পাড়াবাসী দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

গত রবি ও সোমবার ২ ও ৩ মার্চ দুইদিনব্যাপী থানচি বাজারে সাপ্তাহিক হাটবার। বাজারে আসা সিত্লাংপি পাড়া, রেমং পাড়ার বেশ কয়েক পুরুষ ও নারীর সাথে দেখা হয়ে কৌতুহলের সাথে সেখানকার অবস্থার কথা জানতে চাইলেই তারা নিজেদের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় কী যেন বলাবলি করেন। পরে কিছুই হয়নি, সব ঠিক আছে বলে প্রথমে এড়িয়ে যান।

এতে কৌতুহল আরো বেড়ে যায়। সুকৌশলে নিরিবিলি স্থানের ডেকে নিয়ে জানতে চাইলেই নাম প্রকাশ না-করার শর্ত দিয়ে তারা পার্বত্যনিউজের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধিকে বলেন, “আমরা খুব একটা ভালো নেই”।

এ কথা বলার সময় তাদের মাথা নিচু হয়ে যায়, গলা ভারী হয়ে ওঠে, চোখ ভিজে যায়। চোখে-মুখে কেমন যেন ভয়-আতঙ্কের ছাপ দেখতে পাই। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর এ প্রতিবেদকের হাত ধরে বার বার অনুরোধ করে বলেন, “সিংত্লাংপি পাড়া, নিপিউ পাড়া, দুলিচান পাড়া, থাংডয় পাড়া, রেমং পাড়া, বোল্ডিং পাড়া, কাইতং পাড়া, সেরকর পাড়া, শাহজাহান পাড়া, জিন্না পাড়া, স্যালুক্যা পাড়াসহ আমাদের আশে পাশে প্রায় ৩০/৩৫ টি পাড়ার মানুষেরা ঠিকমত কাজ করতে পারছে না। জুমে যেতে পারছে না। এই অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে তারা ভাল নেই। চলাফেরাসহ সব কিছুতে তাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।” এসময় তাদের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

এছাড়াও তারা জানান, “স্থানীয় ৩০ থেকে ৩৫টি গ্রামের মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। জুমের চাষাবাদ ঠিক করে করতে পারছে না। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যদের খাবার জন্য তাদের ঘরের খাদ্য ও গৃহপালিত পশুপাখি এমনকি কুকুর পর্যন্ত দিতে হয় তাদের। কখন যে কী হয় বলা খুবই কঠিন। আমাদের ছেলে মেয়েদের ঠিকমত স্কুলের পাঠানো যাচ্ছে না। আমরাও বাজারে নির্ভয়ে যাতায়াত করতে পারছি না। এছাড়া জুমের ও ফলজ বাগানের উৎপাদিত কলা, কাজুবাদাম, আম, হলুদ, বাদাম, তিল,মরিচসহ কোন কিছু ক্রয় বিক্রয় করতে পারছি না”।

তারা আরও জানান, ”কয়েকজন সর্তকতার সাথে থানচি বাজারে পৌঁছলেও পরিবহন ব্যবস্থা না থাকার কারণে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারছে না। এছাড়া গ্রামের রাস্তাগুলোতে গাছ এবং অন্যান্য জিনিস দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হতে পারছে না তারা। এসব এলাকার লোকজন গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা জানান, এসব এলাকার বাসিন্দাদের জুম-বাগানে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে হলে অনুমতি লাগে। এখন ফসল বিক্রি করতে না পারলে না খেয়ে মরতে হবে”- বলেও জানান তারা।

ট্যুরিস্ট গাইড কল্যাণ সমবায় সমিতি সভাপতি ম্যানুয়েওল ত্রিপুরা ইমন পার্বত্যনিউজকে বলেন, ‌‌‘পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা কারণে দুইশত পর্যটক পথ প্রদর্শক, শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট, হাজারো নৌকার মাঝি কর্মসংস্থান হারিয়ে আজ না খেয়ে আছে। পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ২ হাজার পরিবারের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ নানাবিধ সমস্যা জর্জরিত হচ্ছে’ বলেও তিনি জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২ নং তিন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভাগ্য চন্দ্র ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে বলেন, ‘এতদিন আমরা আইনশৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর তাকিয়ে ছিলাম। যেহেতু সমস্যাটি জাতীয়। তবে এখন আমরা আর তাদের দিকে তাকিয়ে না থেকে এলাকাবাসীদের নিয়ে আলোচনা করে শিগগির সমাধানে রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাব। অতঃপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের সহযোগিতা নেব’।

থানচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও থানচি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অংপ্রু ম্রো পার্বত্যনিউজকে বলেন, ‘তাদের (কেএনএফ) কারণে আমার ইউনিয়নের ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডে ১০-১৫টি গ্রামের ৫ শতাধিক মানুষ আতঙ্কে আছে। এলাকায় নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে স্থানীয়রা। পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ইউনিয়নের মেম্বারদের দিয়ে তাঁদের (কেএনএফ) সাথে আলোচনা করেছি। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য বলেছিলাম কিন্তু তারা (কেএনএফ) আমাদের কথায় কর্ণপাত করেনি’।

তিনি আরো বলেন, ‘এলাকাবাসীদের নিয়ে কেএনএফের বিরুদ্ধে শীঘ্রই কঠোর অবস্থানের মাধ্যমে প্রতিবাদ সভাসহ মানববন্ধন করার প্রস্তুতি চলছে। এছাড়াও তিনি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন’।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে থানচি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি ইমদাদুল হক পার্বত্যনিউজকে বলেন, ‘পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশকে শান্ত করতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সার্বক্ষণিক কথা বলছি।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল মনসুর পার্বত্যনিউজকে বলেন, ‘প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এলাকায় শান্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা চলমান রয়েছে। শীঘ্রই একটা সিদ্ধন্তের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে’।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কুকি-চিন, কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন