২ পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিলীন

চকরিয়ায় ভারী বর্ষণে ভয়াবহ বন্যা, ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি

fec-image

★বিপদ সীমার উপরে মাতামুহুরী নদীর পানি ★নদীতে লাকড়ি ধরতে ও দেয়াল চাপা পড়ে দুই শিশুসহ ৩ জনের মৃত্য ★১৮টি ইউনিয়ন ও চকরিয়া পৌরসভার ১৩০টি গ্রাম পানির নিচে

কক্সবাজারের চকরিয়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে টানা ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভয়াবহ বন্যায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এতে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং চকরিয়া পৌরসভার লোকালয় বানের পানিতে ভাসছে। এই অবস্থায় উপজেলার ১৩০টি গ্রামের অন্তত চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিউবওয়েল ও বসতবাড়ির রান্নার চুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট পড়েছে পানিবন্ধী পরিবার। অনেক স্থানে বাড়ির চালা পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে বানবাসি মানুষ।

এদিকে, মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে অতিক্রম করায় উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের পুরিত্যাখালী ও বিএমচর ইউনিয়নের খুরিল্যারটেক পানির প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ। তলিয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ গ্রামীণ সড়ক, ধানের বীজতলা, মৎস্যঘের, সবজি ক্ষেত ও ফসলী জমি। বানের পানিতে অনেকস্থানে ভেসে গেছে পুকুরের মাছও।

এতে উপকূলীয় মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে নতুন করে ঢুকে পড়ছে বানের পানি। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ভয়াবহ পাহাড় ধসের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

সোমবার (৭ আগস্ট) বিকেলের দিকে বরইতলী ইউনিয়নের ৩নম্বর ওয়ার্ডের মাটির দেয়াল চাপা পড়ে ৩ বছর ও ৬ বছরের দুই শিশুর মর্মান্তিকভাবে মৃত্য হয়েছে। এছাড়াও দুপুরে মাতামুহুরী নদীতে লাকড়ি ধরতে গিয়ে লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের হাজীপাড়া এলাকার এক যুবক পানি স্রোতে তলিয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে খোজাঁখুজি করেও তার কোন সন্ধান মেলেনি। এই পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মাঝে।

এদিকে দুর্গত এলাকার পানিবন্দি পরিবারের জন্য রান্নাকরা খাবারের আয়োজন করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। তার মধ্যে চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম, চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী, চকরিয়া পৌরসভার আলমগীর চৌধুরী, চেয়ারম্যান আজিমুল হক, সাবেক কাউন্সিলর রেজাউল করিম।

বন্যাকবলিত এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা সদরের সাথে ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সড়কগুলো কয়েকফুট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ নৌকায় চেপে যাতায়াত করছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানি তিনদিন ধরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে অতিক্রম করে হচ্ছে।

উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী, কৈয়ারবিল, হারবাং, বরইতলী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী এবং চকরিয়া পৌরসভার বেশিরভাগ গ্রাম কোমর থেকে গলা সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো.আলমগীর চৌধুরী বলেন, টানা বৃষ্টিতে পৌরসভার নীচু এলাকায় অন্তত ৩০টি গ্রাম ও ৫শতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে চকরিয়া পৌরশহর বাঁধসহ পৌরসভার চারপাশের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

চিরিংগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ইতোমধ্যে আমার ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। তার মধ্যে সওদাগরঘোনা, বুড়িপুুকুর, চরনদীপ, রাবার ড্যাম এলাকার গ্রামগুলো নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের মধ্যে।

বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান ছালেকুজ্জামান বলেন, ভারী বর্ষণে ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকায় নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ বেশকিছু গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে রয়েছে। রবিবার সকাল থেকে ইউনিয়নের প্রায় ১০হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভারিবর্ষণে ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি বেড়েছে। সোমবার সকালে ইউনিয়নের খুরিল্যারকুম অংশের ৫০ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় ডুবে যাচ্ছে উপকূলীয় লোকালয়। এতে ব্যাপক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন উপকূলীয় সাত ইউনিয়নের মানুষ।

সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, আমার ইউনিয়ন একেবারে মাতামুহুরী নদী লাগোয়া। নদীতে পানি বাড়তে থাকায় এলাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। মানুষ পানিবন্ধি হয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। চরমভাবে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির অভাব।

পশ্চিম বড় ভেওলা ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে।ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। টানা এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে উপজেলার চিংড়ি জোনের মৎস্য প্রকল্পসমূহ পানিতে তলিয়ে গিয়ে বিপুল পরিমাণ মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।

কাকারা ইউনিয়নের মাঝেরফাঁড়ির বাসিন্দা সাংবাদিক এম আর মাহমুদ বলেন, টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি সকালের দিকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেছে। ঘরের রান্না-বান্না করতে পারছেনা। পরিবার নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছি।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া উপজেলা শাখা কর্মকর্তা (এসও) জামাল মোর্শেদ বলেন, টানা ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রবল বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা ঢলের পানির তোড়ে চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের খুরিল্যারকুম এলাকায় পাউবোর প্রায় ৫০ ফুট এবং কোনাখালী ইউনিয়নের পুরিত্যাখালী পয়েন্টে ভেঙে গেছে। এছাড়াও উপজেলার একাধিক এলাকায় ৬৫ নম্বর পোল্ডারের অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঝুকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন পাউবোর এই কর্মকর্তা।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকা এবং মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানিতে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে উপজেলার এক তৃতীয়াংশ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিতে নিমজ্জিত। এতে অন্তত ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাতে মানুষ চলে যায় সেজন্য মাইকিং করা হচ্ছে। পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকায় জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার স্লুইস গেইট গুলোর কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। যাতে পানি ভাটির দিকে দ্রুত নেমে যেতে পারে।

ইউএনও আরো বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে এখনো পর্যন্ত কোন ধরণের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বরাদ্দ পেলে দ্রুত প্রশাসন থেকে প্রতিটি ইউনিয়নের বানবাসি মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে। শুকনো খাবারের চাহিদা চেয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে দূর্যোগ মোবাবেলায় বিভিন্ন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের লোকজন সার্বক্ষণিক নজর রাখছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: চকরিয়া, পানিবন্ধি, বন্যা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন