নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকাপড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাঁবু যেন কারবালা

নাইক্ষ্যংছড়ির আমতলী-বাইশপাড়িসহ ৭০ কিমি এলাকায় মা-বাবার কোলে পানির জন্যে কাদঁছে এসব শিশু

নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি:
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের আমতলী-সাপমারাঝিরি-বড়ছনখোলা-চাকঢালা ও বাইশপাড়ি পয়েন্টসহ ৭০ কিলোমিটার সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকা পড়া ১৫ হাজার রোহিঙ্গাদের ছোট ছোট তাঁবু যেন এক একেকটা কারবালা।

অস্থায়ীভাবে তৈরী ছেঁড়া-ফাঁটা ত্রিপলের কোনায় কোনায় গোঁজে থাকা রোহিঙ্গা শিশু গুলো পানি পানি বলে চিৎকার দিয়ে কান্না করলেও নিজ নিজ পিতা-মাতারা সামনে পেছনে কোথাও যেতে পারছে না।

একদিকে মিয়ানমারের বিজিপি’র নির্যাতন ও গণহত্যার ভয়, অন্যদিকে বাংলাদেশে সীমান্তরক্ষী বিজিবি’র প্রতিরোধ অবস্থান। ঊভয় সংকটে থাকা এ সব রোহিঙ্গারা সুযোগ খুজঁছে পালিয়ে বাচাঁর জন্যে।

এ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে মানবিক আচরণ দেখাতে বলায় সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের প্রতি কঠোরতা কিছুটা শিথিল করেছে। তবে অনুপ্রবেশ সম্পুর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে তারা।

আর এ শিথিলতার সুযোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কিছু মহৎ ব্যক্তি আটকা পড়াদের মাঝে মধ্যে যৎ সামান্য খাবার দিচ্ছে চাহিদার বিপরীতে। তবে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এতে বাধা দিচ্ছে না মানবিক কারনে,মনে করছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। আর এ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি মানবিক আচরণ কীভাবে করা যায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দফায় দফায় বৈঠক করে যাচ্ছে বিজিবি ও প্রশাসন।

গতকাল ৪ অক্টোবর সোমবার সকালে সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্টিত হয় নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ৩১ বিজিবি কার্যালয়ে। এতে ৩১ বিজিবি ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ও অংশ নেন এ বৈঠকে। এর আগের দিন রোববার সীমান্তের চাকঢালা ও আশারতলী পায়েন্টে ২০ গ্রামের লোকদের নিয়ে পৃথক দুটি বৈঠক করেছিলেন বিজিবি ও উপজেলা প্রশাসন ।

সভাগুলোতে সীমান্তের নো ম্যানস ল্যন্ডে আটকা পড়া রোহিঙ্গা ও অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। আর আটকা পড়া লোকদের সহায়তাকারীদের বিষয়ে নমনীয় মনোভাব দেখাতে সকলের দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়। এছাড়া পালিয়ে আসা কোন রোহিঙ্গা যেন আশ্রয় না পায় গ্রামের লোকজনের প্রতি আহবান জানানো হয় এই সভাগুলোতে।

এসব বৈঠকের কথা স্বীকার করেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বার্হী অফিসার এসএম সরওয়ার কামাল।

এদিকে সীমান্তে আটকে পড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থানস্থল নো ম্যানস ল্যান্ডে সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা হয় পালিয়ে আসা ত্রির্শোধ শামসুল আলম নামের এক ব্যক্তির সাথে।

তিনি জানান, এখনও রোহিঙ্গারা ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসছে সীমান্তে। আর মিয়ানমারের আমকলী-বটতলী সহ উত্তর-পূর্ব সীমান্তে বাড়ি ঘর হারিয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তে চলে আসতে গহীন জঙ্গলে আত্মগোপনে রয়েছে ৭ দিন। তাদের কাছে খাবার ছিল ২ বা ৩ দিনের । এখন কী অবস্থা বলা মুশকিল।

সীমান্ত থেকে ১২/১৩ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় তারা সীমান্তে আসতে ভয় পাচ্ছে। কেননা, সীমান্তে শতশত মিয়ানমার বাহিনী এখনও টহল দিচ্ছে ।

অনুরূপভাবে এ দল থেকে পালিয়ে আসা আবু ছৈয়দ নামের এ রোহিঙ্গা জানান, ফকিরা বাজারের অন্তত ১৭ মাইল পূর্বে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান নেয়া এ টালে অধিকাংশই নারী এবং শিশু। যাদের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজারের অধিক। যারা সীমান্তের ফুলতলী পয়েন্টের নো ম্যানস ল্যান্ডে পালিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।

সীমান্তের সাপমারা পয়েন্টের নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নেয়া মাষ্টার ইকবাল হোছাইন জানান, তার ২ টি শিশু ক’দিন ধরে পানি খেতে পারছে না, বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে। কোথাও পানি নেই। নামাজের ওজুর পানি পর্যন্ত নেই। কাছে কোন ঝর্ণা,ছড়া বা ঝিরিও নেই। সীমান্তে সুপেয় পানি থাকে না বসতি না থাকার কারণে।

তিনি আরো জানান, পানির জন্যে মিয়ানমারের অংশে পা দিলে বর্মি বাহিনীর গুলির ভয়। আর বাংলাদেশ অংশে নো ম্যানস ল্যন্ডের কাছাকাছি কোন গ্রাম নেই। অন্তত ৪/৫ কিলোমিটার এলাকা পার হয়ে নলকূপের পানি নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে বিজিবিও বিপদে পড়বে কীভাবে ?

কেননা এ অবস্থায় কোন রোহিঙ্গা পানির অজুহাতে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার ভয়ের কারণে এখানে অনুমতি দিচ্ছে না বিজিবি।

তিনি আরো জানান, উভয় সংকটের যাতাকলে পড়ে এখন তাদের একেকটি তাঁবু যেন কারবালার প্রান্তর। আজ ৭ রাত ৯ দিন ধরে পানি নেই তাদের শিবিরে।

সাপমারা পয়েন্টে হানিফ নামের অপর রোহিঙ্গা জানান, তাদের এ পয়েন্টে অন্তত ৮ শতধিক শিশু ও ৭ শতাধিক নারী এবং ১ হাজার অন্যান্য স্তরের রোহিঙ্গা গহীন জঙ্গলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে খাবার,বস্ত্র ও পানীয় জল সহনানা কারণে।

এভাবে চাকঢালা পয়েন্টের বড়ঝনখোলা এলাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার এলাকার সর্বত্রই এখন পাণীয় জলসহ জীবন বাচাঁর জন্যে অতিপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের তীব্র সংকট চলছে প্রতিটি তাঁবুতেই।

অপর দিকে সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সোমবার সন্ধ্যায় ৩১ বিজিবি অধিনায়ক লে: কর্ণেল আনোয়ারুল আজিম জানান, সীমান্তের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি স্ট্যন্ডবাই রয়েছে। অনেকটা মানবপ্রাচীরের তৈরীর আদলে বিজিবি টহল দিচ্ছে গহীন বনেও।

বিষাক্ত সাপ, জোঁক বা ভয়ংকর অন্যান্য বন্যপ্রাণী আক্রমনের ভয় উপেক্ষা করে রাত-দিন পাহারা দিচ্ছে বিজিবি জোয়ানরা। আর সীমান্তে পানীয় জল না থাকার বিষয় স্বাভাবিক। এখানো তো বাড়ি ঘর নেই। নলকূপও নেই। তবু বৃষ্টির পানি বা অন্যান্য উৎসের পানি হয়তোবা তারা খাচ্ছে। এ বিষয়ে বিজিবি’র একান্ত দায়িত্ব নিয়ে কিছুই করার নেই। তারা শুধু মানবিতা দেখাবে।

তিনি আরো জানান, সব কিছুর বিনিময়ে বাংলাদেশে কোন রোহিঙ্গা যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে নিয়মিত। তবে তাদের প্রতি মানবিক আচরণের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও তারা পালন করে যাচ্ছেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এ ছাড়া বাংলাদেশেও এ রোহিঙ্গাদের নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে না পারে বিজিবি বা প্রশাসন সদা সজাগ দৃষ্টিতে খোঁজখবর রাখছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন