পার্বত্য শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স কাদের পুণর্বাসন আর কাদের অপসারণ করতে চাইছে?

fec-image

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি ঘ-খণ্ডে বর্ণিত ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পূণর্বাসন এবং অভ্যান্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পূর্ণবাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স গঠিত হয়। ১৯৯৮ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠক অনুযায়ী এই টাস্কফোর্সের প্রধান কাজ হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট হতে ১০ আগস্ট ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান অস্থিতিশীল ও অশান্ত পরিস্থিতির কারণে যে সকল বাংলাদেশী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে শরণার্থী হিসাবে গমন করেছিলেন তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা ও ২০ দফা প্যাকেজ সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে পূণর্বাসন করা। একই সাথে দেশের অভ্যন্তরে ক্ষতিগ্রস্ত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে সরকার ঘোষিত প্যাকেজের আওতায় পূর্ণবাসন সম্পন্ন করা। কিন্তু টাস্কফোর্স গঠনের পর প্রায় ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ এখনও সঠিকভাবে এবং ত্রুটিমুক্ত একটি যাচাই-বাছাইকৃত তালিকা প্রণয়ন করে অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করতে পারে নাই। অথচ এই পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন।


ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পূণর্বাসন এবং অভ্যান্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পূর্ণবাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স বিষয়ক আরো কিছু লেখা:


টাস্কফোর্সের প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কল্পরঞ্জন চাকমা (৮ এপ্রিল ১৯৯৭ – ২০ জানুয়ারি ১৯৯৮) দফায় দফায় স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনকারী ২৮,৩৮৪ উপজাতীয় পরিবারকে ১৬ দফা সরকারী প্যাকেজ সুবিধার আওতায় পূণর্বাসন করেন। এছাড়া ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ১২০০০ শরণার্থী পরিবারকে পূণর্বাসিত করা হয়। এ লক্ষে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা ও ৫.৬৮১.৩৯৮ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়। প্রতিটি পরিবারকে গৃহ নির্মাণ/কৃষি সহায়তা বাবদ এককালীন অনুদান ১৬,০০০.০০ টাকা প্রদান করা হয়। খাদ্য সাহায্য প্রতি পরিবারের জন্য সপ্তাহে ২১ কেজি খাদ্য সহায়তা (ছয় মাস পর্যন্ত) প্রদান করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৯৮ সাল হতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১২,২২৩ উপজাতীয় পরিবারকে ২০ দফা প্যাকেজ সুবিধার আওতায় পূণর্বাসিত করেন। সেই সময় টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন দীপঙ্কর তালুকদার এমপি। একই সালে জনাব দীপঙ্কর তালুকদার এর সভাপতিত্বে ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতীয় পরিবারের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ৮৯.২৮০ টি। একই সাথে সমতল হতে আগত নদী ভাঙ্গা, বাস্তুহীন বাঙ্গালী ৫৭.৬৯২ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার নির্দিষ্ট করা হয়। সরকারীভাবে পুর্ণবাসিত এই বাঙালিদের শান্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে তাদের বসতভিটা ও কবুলিয়তকৃত ভূমি থেকে সাময়িক সময়ের জন্য সরিয়ে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসা হয় এই আশ্বাসে যে, পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারা আবার নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তাদের আর ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। অনেকেই অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছিল। এভাবেও অনেকেই উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে।

এইভাবে ৫৭,৬৯২ বাঙালি পরিবার নিজ দেশের অভ্যস্তরীণ উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এদেরকে পূণর্বাসিত করার জন্য নিয়োজিত পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে তালিকা প্রেরণ করা হয়। কিন্তু ২০১০-২০১২ সালের অনুষ্ঠিত বৈঠকে টাস্কফোর্সের তৎকালীন চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এর প্রত্যক্ষ বিরোধিতা ও পরোক্ষ প্রভাবের প্রেক্ষিতে পূর্বে নির্দিষ্টকৃত ৫৭,৬৯২ ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালী পরিবারকে মূল তালিকা হতে বাদ দেওয়া হয়। মূলত, সন্তু লারমার ইচ্ছা মত বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালী পরিবারকে পূণর্বাসনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দুরভিসন্ধি পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে বাধ্য করা হয় এতে। সন্তু লারমার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাঙালিদেরকে তাদের ভূমিতে পুর্ণবাসনে বাধা দিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে রেখে পরে সুবিধা মত তাদের পাহাড় থেকে সমতলে সরিয়ে নিতে বাধ্য করা। টাস্কফোর্সকে দিয়ে তিনি সে পরিকল্পনা ও নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে একধাপ এগিয়ে রাখেন।

এদিকে উপজাতীয় শরণার্থী পুণর্বাসন নিয়ে দেখা দেয় আরেক গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ প্রশ্ন। ১৯৯১ সালে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনকারী উপজাতীয় ২৮,৩৮৪ পরিবার, ২০০৯ সাল পর্যন্ত পূণর্বাসিত ১২,২২৩ উপজাতীয় পরিবার ও প্রস্তাবিত ৮৯,২৮০ উপজাতীয় পরিবার সব মিলিয়ে হিসাব করলে দাঁড়ায় (২৮,৩৮৪+১২,২২৩+৮৯,২৮০) = ১.২৯,৮৮৭ পরিবার। প্রতিবারে গড়ে ৫ জন সদস্য হিসাব করলে মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৬,৪৯,৪৩৫ জন। এর অর্থ দাঁড়ায় টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যানগণ ও অন্যান্য উপজাতীয় সদস্যগণের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত একজন উপজাতীয় ব্যক্তি/পরিবার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বা নিজভূমিতে ছিলেন না।

তাদের হিসাব মতে, উপজাতীয় সমস্ত ব্যক্তি/পরিবার হয় ভারতে শরণার্থী হয়েছেন, অন্যথায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়েছেন। কিন্তু ১৯৯১ সালের জনশুমারী বা আদমশুমারী ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে। উক্ত বছরে তিন পার্বত্য জেলার মোট জনসংখ্যা ছিল ৯.৭৪.৪৪৭ জন। যার মধ্যে ৪৩.৫৩% ছিল বাঙালী ও বাকী ৫৬.৪৭% ছিল উপজাতীয়। সেই হিসাব অনুযায়ী মোট উপজাতীয় জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ৫.৫০,২৭০ জন।

কিন্তু ১৯৯৭ সালে গঠিত টাস্কফোর্স ২০১০ সালে পৌঁছানোর পর ২০ দফা সরকারী সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পূর্ণবাসন প্যাকেজের আওতায় (১.২৯,৮৮৭×৫)= ৬.৪৯,৪৩৫ জনকে পূণর্বাসন করার উদ্দ্যোগ গ্রহণ করছে। এ প্রস্তাবনাটি ইতোমধ্যে টাস্কফোর্সের বৈঠকের মাধ্যমে পাশ করেছেন। যেখানে জনসংখ্যার চেয়েও (৬,৪৯,৪৩৫-৫.৫০,২৭০) = ৯৯.১৬৫ জনকে বেশী পূর্ণবাসন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এখন জনসম্মুখে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে এই ৯৯.১৬৫ জন উপজাতীয় কে বা কারা?

এখানে আরো উল্লেখ্য যে, বান্দরবান জেলায় কোনো আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ছিলো না এবং রাঙামাটি জেলায় খুবই নগণ্য সংখ্যক উপজাতি উদ্বাস্তু হয়েছিলেন। তাহলে ১৯৯১ সালে বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার জনসংখ্যা বাদ দিলে খাগড়াছড়ি জেলার জনসংখ্যা কত ছিলো? এবং তারমধ্যে ৪৩% বাঙালি বাদ দিলে ১৯৯১ সালে খাগড়াছড়িতে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা কত ছিলো? সর্বোচ্চ লাখ খানেক। এই হিসেব করলে খুব সহজেই আরো প্রশ্ন ওঠে, ইতোমধ্যেই যাদের পুণর্বাসন করা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রকৃত বাংলাদেশী উপজাতি কতজন এবং বাকিরা কারা?

এখনো যাদের পুনর্বাসন করতে চাইছেন তারা কারা? তাদের মধ্যে কতজন প্রকৃত বাংলাদেশী উপজাতি রয়েছেন? স্থানীয়দের ধারণা, এই অতিরিক্ত পূণর্বাসন প্রত্যাশীগণ হলেন, সন্তু লারমার শুভাকাঙ্ক্ষী কিন্তু ভারতে বসবাসরত সেদেশের স্থায়ী বাসিন্দা অথবা খাগড়াছড়ির জনপ্রতিনিধিদের একান্তজনেরা অথবা টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য দেবাশীষ রায়ের আস্থাভাজন উপজাতীয় সদস্যগণ। স্থানীয়দের মতে, ভারতের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দূর্গমতার কারণে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত দূর্বল।

ফলে উভয় সীমান্তে বসবাসকারী অনেক দ্বৈত নাগরিক রয়েছেন যারা মূলত ভারতীয় নাগরিক, কিন্তু উভয় দেশে অবাধ যাতায়াত রয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। এরা ভারতে বসবাস করলেও ভোটের ১/২ দিন আগে দূর্বল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে উপজাতীয় সংগঠনগুলোকে ভোট দিয়ে আবার চলে যায়। এরা মূলত আঞ্চলিক উপজাতীয় সংগঠনগুলোর ব্লক ভোটার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একইসাথে তারা ভারতে বসবাস করে উপজাতীয় সংগঠনগুলোর স্বার্থ রক্ষা, তাদের আশ্রয়, প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। তাদের সাথে অবৈধ সীমান্ত ব্যবসা, অপহরণ প্রভৃতি রাষ্ট্র ও আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী কাজে সহায়তা করে থাকে।

স্থানীয় বাঙালিদের প্রশ্ন, যেখানে বাঙালী ৫৭,৬৯২ পরিবারকে পূণর্বাসন প্যাকেজ হতে বাদ দেওয়ার জন্য উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিবৃন্দ এত উদগ্রীব সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সকল উপজাতীয়কে সরকার ঘোষিত ২০ দফা পূর্ণবাসন প্যাকেজের আওতায় পূণর্বাসন করাটা কি সরকারী অর্থ তসরুপের সামিল নয় কি? অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজকর্মী উল্লেখ করেছেন, টাস্কফোর্সের উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন না করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ আঞ্চলিক উপজাতীয় সংগঠনের প্রকাশ্য দাবী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালী পরিবারকে অপসারণের নীল নকশা বাস্তবায়নে পরোক্ষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা গভীরভাবে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটাই পার্বত্যবাসীর দাবী।

♦ লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পূণর্বাসন এবং অভ্যান্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পূর্ণবাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন