বাঙ্গালী-রোহিঙ্গা বিয়ে থামছেনা

bd_rohingya_bangali_couple_512x288_bbc_nocredi

কাদির কল্লোল:
মাত্র এক মাসে আগে বিয়ে করেছেন এই বাঙ্গালী পুরুষ ও রোহিঙ্গা নারী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশের আইনকে পাশ কাটিয়ে রেজিষ্ট্রেশন না করে গোপনে এ ধরণের বিয়ে হচ্ছে।

তবে কিছুদিন আগে বিয়ে করেছেন, এমন দম্পতির বক্তব্য হচ্ছে, রেজিষ্ট্রশন না করলেও স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতেই তারা বিয়ে করেছেন। তারা বিয়ের ক্ষেত্রে আইনী কোনো বাধা বা নিষেধাজ্ঞা মানতে রাজি নন।
প্রশাসন বলেছে, মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গাদের বৈধতা বা নাগরিকত্ব না দেওয়ার জন্য তাদের সাথে বাংলাদেশিদের বিয়ের ব্যাপারে সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাঙ্গালী এবং রোহিঙ্গার মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। আমরা সেটা মানিনি। এটা বাংলাদেশ সরকার অন্যায় করেছে।

জাকির হোসেন, বাঙ্গালী যুবক। নাফ নদীর তীরে টেকনাফের রঙ্গীখালী গ্রামের জাকির হোসেন। পেশায় তিনি ট্রাক চালক। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের অনিবন্ধনকৃত একটি ক্যাম্পের মোছা:তসলিমার সাথে তার পরিচয় থেকে সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। শেষপর্যন্ত মাস খানেক আগে তারা যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন বাঙ্গালী, রোহিঙ্গার বিয়ের ক্ষেত্রে সরকারের নতুন নিষেধাজ্ঞার খবর আসে। তবে তারা বিয়ে করেছেন বাংলাদেশের আইনকে পাশ কাটিয়ে।

জাকির হোসেন বলছিলেন, “দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার পর সম্পর্ক হয়েছে এবং তারপর আমি ওনাকে বিয়ে করলাম। এখন বাঙ্গালী এবং রোহিঙ্গার মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। আমরা সেটা মানিনি। এটা বাংলাদেশ সরকার অন্যায় করেছে। কেনো রোহিঙ্গারা কি মানুষ নয়। কেন বিয়ে করা যাবে না। সেজন্য আমরা সরকারের নিষেধাজ্ঞা না মেনে বিয়ে করেছি।”

তিনি উল্লেখ করেছেন, “সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা কাজী অফিস বা আদালতে গিয়ে বিয়ে করতে পারিনি। কাবিনানামাও করা যায়নি। আমরা নিজের বাড়িতে মৌলভী ডেকে এনে একটা স্ট্যাম্প এর উপর স্বাক্ষর করে বিয়ে করেছি। দেনমহর হিসেবে একভরি সোনা ধরে নিয়ে, তার কতটা বাকি রাখছি। সেটা এই স্ট্যাম্পেই লিখে দিয়েছি।” হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে। সেখানে আমি রোহিঙ্গা ,বাঙ্গালীকে বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়?

শামসুন্নাহার, রোহিঙ্গা নারী। জাকির হোসেনের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন আত্নীয়-স্বজনের মধ্যেই। রোহিঙ্গা নারী মোছা: তসলিমার প্রেমে পড়ে তিনি আগের স্ত্রীকে তালাক দেন। সেই ঘরে তার দুই সন্তান রয়েছে। এখন জাকির হোসেন নতুন স্ত্রীর সাথে অনিবন্ধনকৃত সেই ক্যাম্পেই থাকছেন।

মোছা: তসলিমাও দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, তার প্রথম স্বামী রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারে বন্দী রয়েছেন। দুই শিশু সন্তান নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে এসে স্বামীর ফিরে আসার জন্য দুই বছর অপেক্ষার পর তিনি জাকির হোসেনকে বিয়ে করেন। তিনি বলছিলেন,“আমার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। আমার জামাই বর্মার কারাগারে বন্দী। আমি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসার পর স্বামীর জন্য দু’বছর অপেক্ষা করেছি। কিন্তু তিনি বন্দী থাকায় আমার দুই শিশু নিয়ে কি করবো। তাই এখানে একজন বাঙ্গালীকে বিয়ে করেছি।”

উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিবন্ধনকৃত কুতুপালং ক্যাম্পের উল্টোদিকের গ্রামে বদিউল আলমের বাড়ি। গ্রামের অন্যদের ঘরের মতোই মাটির দেয়াল,আর সনের চালার ছোট্ট ঘরে দুই শিশু সন্তান এবং স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। দিনমজুর বদিউল আলম ক্যাম্পে যাওয়া আসার সুযোগে রোহিঙ্গা শরণার্থী শামসুন্নাহারের প্রেমে পড়েছিলেন। শেষপর্যন্ত বিয়ে করে তিনি তাঁর এই গ্রামের মাটির ঘরে তিন বছর ধরে সংসার করছেন।

এই বাড়িতে বসে কথা হয় শামসুন্নাহারের সাথে। তিনি বলছিলেন,“আমাদের স্বামী-স্ত্রীর আত্নীয় স্বজনের মধ্যে যাওয়া আসা আছে। ভালবাসা করে বিয়েতে সমস্যা কোথায়। হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে। সেখানে আমি রোহিঙ্গা , বাঙ্গালীকে বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়।” কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের পাশের গ্রামের মসজিদে চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইমামতি করেন মাওলানা ওমর ফারুক। তিনি মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মেয়ে এনে দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে তার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। এক বছরের সেই সংসারে কোন সমস্যা তিনি দেখছেন না। তিনি মনে করেন, বিয়ের ক্ষেত্রে সরকারের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ঠিক নয়।

টেকনাফ-উখিয়ার যে ইউনিয়নগুলোতে এ ধরণের বিয়ে বেশি হয় বলে স্থানীয় লোকেরা বলে থাকেন।
এর মধ্যে রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গির কবির চৌধুরী বলেছেন, “স্থানীয় অনেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থী মেয়ে বিয়ে করে রেশন বা সুযোগ সুবিধা নেওয়ার জন্য তাঁকে ক্যাম্পেই রেখে দিচ্ছে। এ ধরণের সুযোগ নিয়ে বাঙ্গালীদের অনেকেই ঘরে প্রথম স্ত্রী রেখে সময় কাটানো বা আমোদ-ফূর্তি করার জন্য রোহিঙ্গা নারী বিয়ে করছে। এখন এমন তথ্য আমরা পাচ্ছি।”

বাঙ্গালী-রোহিঙ্গার বিয়ের ব্যাপারে কোন পরিসংখ্যান স্থানীয় প্রশাসন দিতে পারেনি। উখিয়া এলাকার বিয়ে নিবন্ধনকারি বা কাজী আবু হারুন মোকাদ্দেস আহমেদ জানিয়েছেন, তিন বছর আগে প্রণীত বিয়ে নিবন্ধন আইনে পরিচয়পত্র এবং জন্মনিবন্ধন থাকাসহ নানান শর্তের কারণে এ ধরণের বিয়ে গোপনে হয় এবং তার কোন হিসাব থাকছে না। এছাড়া এই আইনের আগে কোন বিয়ে হয়ে থাকলে, তাতে রোহিঙ্গারা পরিচয় গোপন রাখতো বলে তিনি উল্লেখ করেন।

যদিও এখন বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে স্থানীয় লোকেদেরই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে, আইনের পাশাপাশি সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা মাঠপর্যায়ে কার্যকর করায় বাঙ্গালীদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার প্রবণতা কমে আসবে।

সূত্র: বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন