বান্দরবানে হতদরিদ্রদের চাল বিতরণে নয়-ছয়

fec-image

অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বান্দরবান পার্বত্য জেলার ৪টি উপজেলায় হতদরিদ্রদের নামে ১০ টাকা দরে কেজির চাল ক্রয়ের কার্ড বিতরণে অনিয়মের নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাল ক্রয়ের কার্ড পেয়েছেন অধিকাংশ সরকার সমর্থক, চাকুরীজীবি,ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সরকারের মহৎ কাজটি সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃত হতদরিদ্র পরিবারগুলো বঞ্চিত হওয়ায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এত লাভবান হয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও দুর্ণীতি পরায়ন সংলিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তারা।

জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, বান্দরবানের সাত উপজেলায় আগস্ট মাস থেকে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ কর্মসূচি শুরু হয়। কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের দাপট এবং প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তাদের বদৌলতে বেশির ভাগ কার্ড পেয়েছেন বিত্তশালী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, চাকুরীজীবী, এনজিও কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে রোয়াংছড়ি, রুমা এবং থানছি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের প্রায় ৯০শতাংশ কার্ডই পেয়েছেন এসব বিত্তশালী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, থানছি উপজেলায় হতরিদ্রদের কার্ড নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১১শত হতদরিদ্র পরিবারকে তালিকাভক্তি করা হলেও অধিকাংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা ও চাকুরীজীবি এবং সাবেক জনপ্রতিনিধিরা হতরিদ্রদের কার্ড পেয়েছেন। এসব অভিযোগ দেয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের কার্যালয়ে গেলেও অফিসে কাউকে পাওয়া যায় না।

অভিযোগ বিষয়ে জেলা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা বলেন, তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ নেই ১০টাকা কেজি দামের চাল বিক্রিতে অনিয়ম নিয়ে। তবে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জেলার রুমা উপজেলায় ৪টি ইউনিয়নের দুই হাজার ১৬১জন হতদরিদ্র পরিবার তালিকাভূক্ত করা হয়। রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের পাড়া প্রধান (কারবারী) উচু মারমা,ছোরি মারমা এবং ক্যহ্লাপ্রু মারমাসহ অনেকেই অভিযোগ করেছেন তাদের পাড়ার অনেকেই কার্ডের বিপরীতে চাল কিনতে পারেননি। আর টাকা দেয়ার পরও ইউপি সদস্যরা কার্ড দেরিতে বিতরণ করায় গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ১০টাকায় চাল কেনার সুবিধা পায়নি। অফিস খরচের নামে জনপ্রতি কার্ড বাবদ দুই হাজার টাকা করে পাইন্দু ইউপি সদস্য মংসিংথোয়াই মারমা ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যা ছোমেচিং মারমা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন।

অবশ্য পাইন্দু ইউপি সদস্য মংসিংথোয়াই মারমা বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কার্ড প্রতি দুইশত টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়নি। দুর্গমতার কারণে কার্ডধারী অনেকেই উপজেলা সদরে গিয়ে ডিলারদের কাছ থেকে ১০ টাকা দামের চাল ক্রয়ে অনিচ্ছুক। এ ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা সদস্যা ছোমেচিং মারমা হতদরিদ্রদের কাছ থেকে কথিত অফিস খরচের নামে কার্ড বাবদ দুই হাজার টাকা নিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। কার্ডগুলো বিতরণ না করে নিজের কাছে রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।

পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বলেন, বিবিধ খরচ মিটানোর জন্য কার্ডধারীদের কাছ থেকে ৫০টাকা হারে আদায় করার জন্যে ইউপি সদস্যদের বলা হয়েছে। রেমাক্রী প্রাংসা ও গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ডিলার ও স্থানীয় ইউপি সদস্যদের যোগসাজশে নামে-বেনামে কার্ড বিতরণ ও চাল দেয়া-নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বান্দরবান সদর উপজেলার দুই হাজার ৬৫৪টি হতদরিদ্র পরিবারকে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এখানেও চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৫০% সচ্ছল পরিবার কার্ড পেয়েছেন। প্রকৃত হতদরিদ্র পরিবারগুলো সরকারি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সদর উপজেলার রেইছা ইউনিয়নের গোনা পাড়া, সিনিয়র পাড়া, সাতকমল পাড়া, রেইছা পাড়ায় হতদরিদ্ররা অভিযোগ করেন, ভিজিএফ কার্ডধারী পরিবারগুলোই ১০ টাকা কেজি দামের কার্ড পেয়েছেন। রেইছা এলাকার গোনা পাড়ার বাসিন্দা মোছাম্মদ ফাতেমা খাতুনসহ বেশ কয়েক জন অভিযোগ করেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে স্বাক্ষর দিলেও চাল বিতরণ করা হয়নি। অধিকাংশ কার্ডধারী ৩০ কেজির স্থলে ২৮-২৯ কেজি করে পেয়েছেন।

সুয়ালক ইউনিয়নের স্থানীয়দের লিখিত অভিযোগে জানা যায়, ইউপি সদস্যা রিনা বেগমের ভাইসহ নিজ পরিবারের নামে একাধিক কার্ড রয়েছে।এছাড়াও অভিযোগে সচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকায় সরকারি চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী পরিবারও ১০টাকায় চাল কেনার কার্ড পেয়েছে।

রোয়াংছড়ি উপজেলায় চালের কার্ড বিতরণ ও বিক্রয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়নে এক হাজার ৭৯১ জন কার্ডধারীর মধ্য সচ্ছল, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। ৩০ কেজি করে দেয়ার কথা থাকলেও তারা চাল পাচ্ছেন ২৮ বা  ২৯ কেজি হারে।

শুধু মাত্র রোয়ংছড়ি উপজেলার আ’লীগের সহ-সভাপতি দীপক ভট্টাচার্য্য’র কার্ড বাতিল ছাড়া প্রশাসন হতদরিদ্রদের নামে ১০ টাকা দরে কেজির চাল ক্রয়ের কার্ড বাতিল ছাড়া আর কার্যত: কোন তথ্য চোখে পড়েনি।

বান্দরবান সদর উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসের মো. ইউছুপ জানান, সরকারের ১০ টাকা দরে চাল বিতরণের কার্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমবারে তাড়াহুড়া করে করার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ কিছু লোক ঢুকে পড়েছে। সামনের বারে তাদের নাম তলিকা থেকে বাদ দেয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন