বিলম্বিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বাড়ছে রোহিঙ্গাদের অপরাধ

fec-image

আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে (২৫ আগস্ট) বানের স্রোতের মতো রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে। মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার জোরপূর্বক বিতাড়িত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ঠিকানা এখন বাংলাদেশ। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি শিবিরে তাদের বসবাস। এর বাইরে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। কিছু সংখ্য রোহিঙ্গা ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনেকে পালিয়েও এসেছে।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরী মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার। স্থানীয় বাসিন্দারাও শুরু থেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে, রোহিঙ্গা আগমনের এই চার বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় লোকজন ও সামাজিক পরিবেশ। সবুজ বন উজাড় হওয়ায় আবাসস্থল হারিয়েছে বন্য হাতি। মাদক, অন্তঃকোন্দলে খুনখারাবির ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘটছে খুন ও অপহরণের ঘটনা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় রোহিঙ্গাদের অপরাধের ভার পড়ছে বাংলাদেশে।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন দাবি করেছে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি। এ দাবিতে বুধবার (২৫ আগস্ট) সকাল ১০টায় কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরী সড়কে অবস্থান কর্মসূচি ডাকা হয়েছে। এতে সবাইকে অংশ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি মাহাবুবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইমাম খাইর।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এই রোহিঙ্গা আসার পর থেকে আমরা স্থানীরা সমস্যায় আছি। ভয়ে দিনযাপন করছি। কারণ তাদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি মাদক ইয়াবা বেশি আসছে বাংলাদেশে এই রোহিঙ্গার হাত ধরে। গতকালও একটি বড় চালান র‌্যাব আটক করে। এতে কিছু স্থানীয় মদদদাতা আছে বলে মনে হচ্ছে। আমরা এদের দ্রুত প্রত্যাবাসন চাই।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিস ফোরামের সভাপতি আনম হেলাল উদ্দিন জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কেব হবে, সেদিকে তাকিয়ে আছে কক্সবাজারবাসী। কিছু এনজিও, আইএনজিও তাদের ব্যবসা চালিয়ে রাখতে তাদের রাখাইন রাজ্যে না যেতে উৎসাহিত করছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির কারণে স্থবিরতা বিরাজ করছে। সে হিসাবে হয়তো প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা বেশি প্রচার পাচ্ছে না। তবে আমরাও চাই দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হউক। কক্সবাজারকে বাঁচাতে হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোন বিকল্প নেই।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, মিনিষ্টার ফরেন এফেয়ারস্ (মুফা) বিষয়টি দেখছে। তারা প্রত্যাবাসন সর্ম্পকে ভাল জানেন। প্রত্যাসনে সরকারও চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, সরকার যথন নির্দেশ দিবে তখন প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হবে।

আরআরআরসি অফিসের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৩০ হাজার ৪০০ জন শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে জন্ম লাভ করে। তবে আগমনের প্রথম বছর এ সংখ্যা ছিলো আরো অনেক বেশি। সে হিসাবে গত ৪ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ শিশু ক্যাম্প সমুহে জন্ম নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এতিম রয়েছে, ৩৯ হাজার ৮৪১ জন। এরমধ্যে ১৯ হাজার ৫৯ জন ছেলে ও ৮২ হাজার ৮৮২ জন মেয়ে। আবার এরমধ্যে, ৮ হাজার ৩৯১ জনের মাতা-পিতা কেউ নেই।

এদিকে, আরআরআরসি অফিসের পরিসংখ্যান মতে, বছরে গড়ে ৩০ হাজার ৪০০ জন রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্পসমুহে জন্ম লাভ করে। তবে আগমনের প্রথম বছর এ সংখ্যা ছিলো আরো অনেক বেশি। সে হিসাবে গত ৪ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ শিশু জন্ম নেয়। বছরে গড়ে গর্ভবতী হয় হয় ৩৫ হাজার ৪ জন মহিলা।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে উখিয়া টেকনাফের ভূমি ব্যবহার করা হয়েছে ৬,৫০০ একর। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। তখন বাংলাদেশে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে আড়াই লাখ মিয়ানমার পরে ফিরিয়ে নিয়েছিল। ১৯৯২ সালে আসে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৭ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে। ফলে প্রতিবারই কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে গেছে। ১৯৯২ সালের পর আরও বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গারা এলেও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগ আর দেখা যায়নি।

প্রায় ১৬ বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি নতুন সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এমওইউ অনুযায়ী, দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে পারেনি। নানা অজুহাতে থমকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিক বা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মূল সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা বা স্থায়ীভাবে রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে প্রস্তাবটিকে অবাস্তব বা কল্পনাপ্রসূত অভিহিত করে নাকচ করে দিয়েছে সরকার।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধ, প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন