রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ায় বাড়ছে অস্থিরতা ও অপরাধ

fec-image

অর্থ সঙ্কটের কারণে চলতি বছরের মার্চে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিন মাসের মাথায় আরেক দফা তাদের খাদ্য বরাদ্দ কমলো। দাতাদের থেকে পর্যাপ্ত অর্থ সহযোগিতা না আসায় খাদ্যে কাটছাঁট করতে বাধ্য হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। বরাদ্দ কমায় ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে আর্থসামাজিক অস্থিরতা। অর্থের জোগান দিতে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এতে উদ্বিগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডব্লিউএফপি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাশাপাশি খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘ। এ কারণে অর্থ সঙ্কটে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। তিন মাসের ব্যবধানে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সংস্থা দুই দফা কমিয়েছে অর্থ বরাদ্দ। চলতি বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়। সর্বশেষ গত ১ জুন থেকে ওই বরাদ্দ আরও কমিয়ে আট ডলার করা হয়েছে। এ কারণে ক্যাম্পে পুষ্টি, স্বাস্থ্যসহ জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা। অর্থের জোগান দিতে কেউ কেউ অপরাধে জড়াচ্ছেন।

রোহিঙ্গা নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, নানা জটিলতায় ছয় বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। ইতোমধ্যে দাতা সংস্থাগুলো অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে নতুন করে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। গত ১ মার্চ থেকে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি রেশন ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছিল। জুন মাসে আরও কমিয়ে জনপ্রতি মাসে আট ডলার অর্থাৎ ৮৪০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। হিসাবে দৈনিক রেশন কমেছে ৩৩ শতাংশ। এতে উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গাদের মাঝে।

হতাশার কথা জানিয়ে উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা মাস্টার জোবাইর বলেন, ‘সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমেছে অর্থ বরাদ্দ। রোহিঙ্গারা আগে যে পরিমাণ রেশন পেতেন, এখন তা পাচ্ছেন না। এতে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্যাম্পে নানা ধরনের অপরাধের পাশাপাশি অস্থিরতা আরও বাড়বে।’

শুরুতে আমরা যে পরিমাণ রেশন পেতাম, এখন তা পাই না উল্লেখ করে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা খালেদা বেগম বলেন, ‘এই রেশন দিয়ে সংসার চলে না। এতে আমার স্বামী ও ছেলেরা ক্যাম্পের বাইরে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়। ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে মাসে ১০-১৫ দিন মজুরি দেয় তারা। ওই অর্থ দিয়ে সংসার চলে। যারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না, তাদের সংসার চলছে কষ্টে।’

উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) ইঞ্জিনিয়ার মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ছয় বছর পার হলেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়েছে। কারণ কাজের সন্ধানে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন। এতে আমরা শঙ্কিত।’

অর্থ বরাদ্দ কমানোকে বড় ধরনের বিপর্যয় বলেছেন বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডম স্কালপেল্লি। তিনি বলেন, ‌‌এতে অন্যান্য অতি জরুরি সেবাগুলো সংকুচিত হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য সহায়তায় এই পরিবর্তনের প্রভাব হবে মারাত্মক। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে রোহিঙ্গারা মানবিক সহায়তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। বরাদ্দ কমায় খাদ্য ও পুষ্টিসহ অন্যান্য নানা জরুরি বিষয়ে রোহিঙ্গার ওপর প্রভাব পড়বে।

কান্ট্রি ডিরেক্টর স্কালপেল্লি আরও বলেন, ‘প্রতিবার খাদ্য সহায়তা কমানোর সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবে অপুষ্টির পরিমাণ বাড়বে। খাদ্য সহায়তা কমানোর সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পরিবারগুলো বিপজ্জনক পথ বেছে নিতে থাকবে। এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়বে নারী, কিশোরী ও শিশুদের ওপর।’

জানতে চাইলে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমানোর ফলে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসহ জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাড়বে অপরাধও। তবে সব কিছুর সমাধান হচ্ছে যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা।’

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন উল্লেখ করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে এ পর্যন্ত বাছাই করেছে মিয়ানমার। কিন্তু তাদেরও ফেরত নেয়নি তারা।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা করতে গত ২৫ মে বাংলাদেশে আসেন মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ’র নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এর আগে গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল রাখাইন সফর করেন। এর আগে ১৫ মার্চ মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। সে সময় ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমারে ফিরে যায় দলটি। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধ, খাদ্য সহায়তা, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন