রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেড়েছে অপরাধ, ১৪টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়

fec-image

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বাসিন্দারা দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা। একইসঙ্গে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ। গত সাড়ে পাঁচ বছরে ক্যাম্পে ১৬৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা।

ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন, মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আবার অপহরণ করে চাঁদা না পাওয়ায় কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ইয়াবা, মানব পাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অন্তত ১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। তাদের মাধ্যমে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। চলছে অস্ত্রের মহড়া। অপহরণ ও ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ সোমবার (১৯ জুন) সকালে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলিতে ইমান হোসেন (১৮) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। এ সময় আহত হন আরও একজন। এর আগে ১৭ জুন কুতুপালং ক্যাম্পে নূর হোসেন প্রকাশ ভুট্টো (৪২) নামে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাকে (সাব মাঝি) গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পগুলোতে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৬৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্য গত দুই বছরে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নিহতদের বেশিরভাগ ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রথমদিকে ‘আরসা’ নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভিন্ন মত থাকলেও ক্যাম্পের দুই রোহিঙ্গা নেতা, তিন মাঝি ও ছয় মুসল্লিসহ দুই ডজন খুনের ঘটনায় আরসা জড়িত বলে জেনেছেন তারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তারা আরসা নয়; বরং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।

চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত আবদুল হাকিম গ্রুপ, ডাকাত মো. সালেহ গ্রুপ, ইসলামিক মাহাস গ্রুপ ও আল-ইয়াকিন গ্রুপ অন্যতম। এর পাশাপাশি ‘আরসা’ পরিচয় দিয়ে আরও কয়েকটি গ্রুপ ক্যাম্পে সক্রিয় আছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজি ঘটনায় এসব গ্রুপের সদস্যরা জড়িত।

ক্যাম্পে বেড়েছে অস্ত্রের ব্যবহার, প্রকাশ্যে ঘটছে হত্যাকাণ্ড
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্রের ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, হত্যা ও অপহরণের ঘটনা বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গত জুন থেকে চলতি জুন মাস পর্যন্ত ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও শতাধিক গোলাবারুদসহ ১৬৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি ২৬ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ও ২৯ কেজি আইসসহ ৭৭৯ জন রোহিঙ্গা অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। একই সময়ে ৪৮ জন খুন হন। বেশিরভাগ ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জড়িত। এসব ঘটনায় ১১৬ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৩৬ রোহিঙ্গাকে অপহরণের ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন অপহরণকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে টেকনাফের নয়াপাড়া, উনছিপ্রাং ও শালবন এবং উখিয়ার লম্বাশিয়া, কুতুপালং, জামতলী, ময়নারঘোনা ও মধুরছড়া ক্যাম্পে।

ক্যাম্পে অপরাধ বেড়েছে উল্লেখ করে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘কয়েকটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় আছে। মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড ঘটছে। তবে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। যারাই অপরাধ করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৮-এর বাসিন্দা রহিম উল্লাহ বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয়। এর মধ্যে কেউ আরসা পরিচয়ে, কেউ নিজেদের নেতার নাম বলে মাদক ব্যবসা, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। আবার মুক্তিপণের টাকার ভাগ নিয়েও হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা।’

তিনি বলেন, ‘গত মে মাসে উখিয়ার তাজনিমারখোলা এলাকায় আরসা পরিচয়ে চাঁদাবাজি করায় একজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল রোহিঙ্গরা। এর আগে বালুখালী ৯ নম্বর ক্যাম্পে নূর হাবি ওরফে ডা. ওয়াক্কাসকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ওয়াক্কাস নিজেকে আরসার কমান্ডার পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাতো। এ ছাড়া বালুখালী ৮-ইস্টের বি-৩৫ ব্লকে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তারাও আরসা সদস্য বলে পরিচয় দিতো।’

এ বিষয়ে ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘অনেকে আরসার পরিচয় দিলেও আসলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সদস্য। মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনটি ক্যাম্পের হেড মাঝি বলেছেন, ক্যাম্পে অস্ত্র নিয়ে রাতে মহড়া দেয় একটি গ্রুপ। নিজেদের আরসা পরিচয় দিয়ে প্রত্যেক ব্লকে গিয়ে যুবকদের গ্রুপের সদস্য হিসেবে যোগ দিতে আহ্বান জানায়। কখনও কখনও বাধ্য করে। সেইসঙ্গে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অধিকাংশ অপরাধে তারা জড়িত।

ক্যাম্পে আরসার পাশাপাশি আরএসও সক্রিয় বলে দাবি করেছেন কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচএম নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মাদক থেকে শুরু করে অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মাঝেমধ্যে অপরাধ ও হত্যাকাণ্ড ঘটায় আরসা ও আরএসও। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান প্রত্যাবাসন। অন্যতায় কক্সবাজারের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধ, রোহিঙ্গা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন